দুটি ট্রফির দুই কোনায় দুই অধিনায়ক প্রতিপক্ষের সঙ্গে মিলে হাত ছুঁয়েছেন। এককভাবে ট্রফি হাতে তুলতে পারেননি। না মুশফিকুর রহিম, না মাশরাফি বিন মুর্তজা। টেস্ট সিরিজের পর ওয়ানডেতেও একই দৃশ্য। টি-টোয়েন্টি সিরিজে এখন বড়জোর ওই দৃশ্যটা কল্পনা করা যেতে পারে। তা-ও সে জন্য বাংলাদেশকে আজ শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি জিততে হবে প্রবলভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে। সেটি সম্ভব কি না, কোটি টাকার প্রশ্ন।
কিন্তু সব ছাপিয়ে কলম্বোর রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে কিংবা হোটেল তাজ সমুদ্রে দীর্ঘ এক শরীরের ছায়া উঠছে বড় হয়ে। সেটি আর কারোর নয়, বাংলাদেশের সীমিত ওভারের ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার। পরশু প্রথম টি-টোয়েন্টিতে হঠাৎ অবসর ঘোষণা করে নিজের ছায়াটিকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে দিয়েছেন মাশরাফি। ম্যাচের আগে টসের সময় হঠাৎ এমন অবসরের ঘোষণায় শ্রীলঙ্কান সাংবাদিকেরাও অবাক। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফিকে তাঁরাও প্রশ্ন করলেন এ নিয়ে। প্রেমাদাসার অনেক কর্মীর আবদারে মাশরাফিকে সেলফিবন্দী হতে হলো।
সবার আগে নিজের ফেসবুক পেজে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তাঁকে বিদায়ী অর্ঘ্য নিবেদন করলেন তাঁর সতীর্থরা। টেস্ট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম লিখেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের কাছেই ম্যাশ ছাড়া বাংলাদেশ দলকে চিন্তা করাটা কষ্টের। আপনি সত্যিকারের এক চ্যাম্পিয়ন। আমি নিশ্চিত, আমার মতোই প্রত্যেকে আপনার মতো অধিনায়কের অধীনে খেলতে পেরে গর্বিত।’
টেস্ট দলের সহ-অধিনায়ক তামিম ইকবালের শ্রদ্ধার্ঘ্য, ‘যত বেশিই বলা হোক না কেন, মাশরাফি ভাইয়ের সম্পর্কে বলাটা কম হয়ে যাবে। তিনি দেখিয়েছেন ড্রেসিংরুমকে কীভাবে একটি পরিবারের মতো চালিয়ে নিতে হয় এবং একই সঙ্গে ছিনিয়ে আনতে হয় বিজয়। আমার চোখে মাশরাফি এক জীবন্ত কিংবদন্তি।’
ফাস্ট বোলার তাসকিন যেন ২২ গজে হারিয়ে ফেললেন একজন অভিভাবককে, ‘জানি না, আর কত দিন এই হাতটা খেলার মাঠে আমার কাঁধে পাব…জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার আগ থেকেই আপনি আমার আইডল, আর তিন বছর ধরে একজন অভিভাবকের থেকেও অনেক বেশি কিছু…।’
শোকাচ্ছন্ন মাহমুদউল্লাহর অন্তর, ‘আমরা আপনাকে খুব মিস করব, বিশেষ করে আমি। আপনি ছিলেন আমার ভাই, বন্ধু, যাঁর সঙ্গে আমি সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারতাম। আপনি এক যোদ্ধা, এক অসামান্য নেতা ও অধিনায়ক, একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। ম্যাশ, আপনাকে আমরা সবাই ভালোবাসি।’
আর কাল দুপুরে মোসাদ্দেক হোসেন তাজ সমুদ্রের সামনে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে গেলেন, ‘দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা আমরা মাশরাফি ভাইয়ের জন্য খেলব। আমরা সবাই মিলে ম্যাচটি জিতে বিদায়ী উপহার দিতে চাই মাশরাফি ভাইকে।’
সাংবাদিকের সঙ্গে মোসাদ্দেকের কথা শেষ হতেই হোটেলে ঢুকলেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানকালের এক নায়ক। খেলা দেখতে এসেছেন সাবেক অলরাউন্ডার। এই প্রতিবেদককে দেখে মাথা ঝাঁকালেন দুই দিকে, ‘মনটা ভীষণ খারাপ। মাশরাফির মতো খেলোয়াড়কে কেন বিদেশের মাটিতে অবসর নিতে হবে? ও আমাদের ক্রিকেটের গৌরব, ও তো অবসর নেবে দেশের মাঠে, ৫০ হাজার মানুষের সামনে।’
এই বাংলাদেশ দল অন্য রকম। তারা যখন কারও সম্মানে খেলে, হয়ে ওঠে দুর্বার। মনে আছে ২০০৭ বিশ্বকাপের কথা? সেই যে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানার স্মৃতি নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন মাশরাফিরা! মাশরাফিই বলেছিলেন, ‘এই ম্যাচটি রানার জন্য।’ তারপর যা ঘটল, তা ইতিহাস। মাশরাফি-তামিম-মুশফিকদের কাছে বিধ্বস্ত হলো পরাক্রান্ত ভারত।
এখানে খেলাটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। এই সংস্করণে শ্রীলঙ্কাও বাংলাদেশের কাছে অমন পরাক্রান্ত। তাদের আছে কুশল পেরেরা, উপুল থারাঙ্গা, আসেলা গুনারত্নের মতো বিস্ফোরক সব ব্যাটসম্যান, লাসিথ মালিঙ্গার মতো বিধ্বংসী বোলার। শ্রীলঙ্কাকে হারানো সহজ নয়। তারপরও কি বলা যায়, বাংলাদেশ লড়াইয়ের আগেই হার মেনে নেবে। প্রথম ম্যাচে সহজ জয়ই পেয়েছে শ্রীলঙ্কা, তবে মনে হয় না বাংলাদেশকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারছে। সৌম্য-সাব্বিরের জুটিটা যদি আরেকটু বড় হতো, যদি তাসকিন আরেকটু চেষ্টা করে কুশল পেরেরার ক্যাচটি নিতে পারতেন, ম্যাচের রং বদলাতেই পারত।
এই ভুলগুলো আজ শোধরানোর চেষ্টা করবেন সাকিব-তামিমরা। তাঁরা যে খেলবেন অধিনায়কের জন্য! রাতের প্রেমাদাসায় বাংলাদেশকে আজ বিজয়ী দেখা যেতেই পারে।
যেখানে আলোর উচ্ছ্বাসে মাশরাফির মুখে এক টুকরো বিষণ্নতা থাকবে। তবে গর্ব ও বিজয়ের অনুভূতিটাই যেখানে ঝলমল করবে বেশি। মাশরাফির মতো একজন চ্যাম্পিয়নের বিদায়ী ম্যাচে বিজয়ই সর্বোত্তম অর্ঘ্য।
পাঠকের মন্তব্য