ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে আয়াতুল্লাহ অথবা ইমামরা দেশ পরিচালনা করবেন, সেটা কাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেটা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে একজন ধর্মীয় নেতা সরকার গঠন করবেন—হোক সে রাজ্য সরকার—সেটা মোটেও স্বাভাবিক কিছু নয়। এই ধর্মনিরপেক্ষ তকমা আঁটা রাষ্ট্রটি হচ্ছে ভারত, যেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত। বস্তুত, বৃহত্তম এই গণতন্ত্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকেই দেশটির ধর্মনিরপেক্ষতার ইমেজ কিছুটা ফিকে হতে থাকে। আর এখন দেশটির বৃহত্তম রাজ্য, যেটি একটি আলাদা দেশ হলে বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল রাষ্ট্র হতো (বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ), সেই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিমবিদ্বেষ প্রচারের জন্য পরিচিতি পাওয়া তরুণ পুরোহিত আদিত্যনাথ যোগী।
ঠিক যেদিন ইউরোপবাসী নেদারল্যান্ডসের ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতিক গিয়ার্ট ভাইল্ডার্সের পরাজয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন, তার চার দিন পর ভারতের বৃহত্তম রাজ্যটিতে একজন চরম মুসলিমবিদ্বেষী পুরোহিতের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ায় বিশ্বের নানা প্রান্তে উদারপন্থীরা নড়েচড়ে বসেছেন। অবশ্য, গোরক্ষপুর মন্দিরের পুরোহিত আদিত্যনাথকে শুধু মুসলিমবিদ্বেষী বললে সম্ভবত কম বলা হয়। তিনি আসলে উগ্র হিন্দুত্ববাদী। তিনি খ্রিষ্টান সন্ত মাদার তেরেসাকেও ছাড়েননি। মাদার তেরেসার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল যে তিনি খ্রিষ্টধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে ভারতকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। হত্যা, দাঙ্গা ও ভীতি প্রদর্শনের একাধিক মামলায় তিনি আসামি। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও গার্ডিয়ান–এর মতো পত্রিকাগুলো এই নির্বাচন নিয়ে বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে, যেগুলোতে স্পষ্টতই একে ভারতে পশ্চাৎ–মুখী যাত্রা বলে অভিহিত করা হয়েছে। যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থানে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এখন অস্থিরতা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, সেই রাজনীতির দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমাদের দীর্ঘদিনের। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভিত্তিতেই একসময় উপমহাদেশের বিভাজন হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সাধারণত কোনো সীমান্তের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়া যে শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেই নজিরও নিশ্চয়ই আমরা বিস্মৃত হইনি। ওই একই কারণে বাংলাদেশে যখন জামায়াতের মতো দল সরকারের শরিকানা পেয়েছিল, তখন আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী অস্বস্তিতে ভুগেছে। এখন যে তার উল্টোটা হবে না, এমন ভাবনার অবকাশ আছে কি?
আদিত্যনাথকে নিয়ে এসব উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, তাঁর রাজনৈতিক অতীত। প্রধানমন্ত্রী মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি—বিজেপি হচ্ছে একমাত্র দল, যারা উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের প্রচারকাজে সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, তা খোলাসা করেনি; যেমনটি করেছিল কংগ্রেস-সমাজবাদী পার্টির জোট অখিলেশ যাদবকে কিংবা বহুজন সমাজ পার্টি মায়াবতীকে। রাজ্যের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী দলের বিজয় নিশ্চিত করেন। কিন্তু তারপরই তিনি সবাইকে চমকে দেন গোরক্ষপুর মন্দিরের পুরোহিত আদিত্যনাথকে রাজ্যের প্রধান হিসেবে বেছে নিয়ে। গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক জীবনকে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তারপর সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তিনি ধর্মভিত্তিক বিভাজনের নীতিকেই দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ভারতে অভিবাসীদের আশ্রয় এবং নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়কে ভিত্তি বিবেচনার অঙ্গীকার করে তিনি যে রাজনৈতিক ধারার সূচনা করেছেন, আদিত্যনাথ তারই আরও এক ধাপ বেশি কট্টরবাদী সংস্করণ।
ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে উত্তর প্রদেশের গুরুত্বই আলাদা। কেন্দ্রে সরকার গঠনে লোকসভার ৫৪৫ আসনের মধ্যে ৮০টিই
এই রাজ্যের। আবার, ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা ব্যাপক। এখন থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে ভারতে যে প্রাণঘাতী দাঙ্গা হয়েছিল, তার উৎসে ছিল অযোধ্যার বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিরোধ। মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের গোড়ার দিকে গোমাংসকেন্দ্রিক সহিংসতার সূত্রপাতও এই রাজ্যে। মোগল শাসকদের অন্যতম প্রধান স্মারক তাজমহলের অবস্থান এই রাজ্যের আগ্রা শহরে।
হিন্দু যুব বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা আদিত্যনাথ সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর মিলন বৈষ্ণব গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছেন, তাঁর পরিচিতি পাওয়ার পেছনে বক্তৃতা-বিবৃতিতে চরম পন্থা অনুসরণ, জনতাকে উত্তেজিত করায় পারদর্শিতা এবং কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্য আত্মনিয়োগ ছাড়া আর কিছু নেই। হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে মুসলমান তরুণের প্রেম হিন্দু জনসংখ্যা কমানোর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রচার করে তিনি তার বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়ে খ্যাতি পান, যা লাভ জিহাদ নামে পরিচিত। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ২০১৫ সালে গরুর মাংস খাওয়ার সন্দেহে একজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা সমর্থন করেছিলেন আদিত্যনাথ। সূর্যোদয়ের সময়ে যোগসাধনের মাধ্যমে দেবতা হিসেবে সূর্যকে পূজা করতে অস্বীকৃতি জানানো মুসলমানদের তিনি সাগরে ডুবে মরার উপদেশ দিয়েছিলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২৪ মার্চ এক বিবৃতি দিয়ে আদিত্যনাথকে তাঁর মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। অ্যামনেস্টি এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতিও একই দাবি জানিয়েছিল। আদিত্যনাথের যে বক্তব্যটি অ্যামনেস্টি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে, সেটি অবশ্য ট্রাম্পের প্রকাশ্য বক্তব্য-বিবৃতির চেয়েও অনেক বেশি উসকানিমূলক ও ক্ষতিকর। অ্যামনেস্টি তাঁর ওই বক্তৃতার ভিডিওকে উদ্ধৃত করে বলছে যে ২০১৪ সালে এক বক্তব্যে আদিত্যনাথ বলেছিলেন যে একজন মুসলমান যদি একজন হিন্দু তরুণীকে ফুসলিয়ে নেয়, তাহলে আমরা ১০০ জন মুসলমান মেয়েকে নিয়ে নেব; তারা যদি একজন হিন্দুকে হত্যা করে আমরা ১০০ মুসলমানকে হত্যা করব। অ্যামনেস্টি বলছে যে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজয়ের পর থেকে ভারতে ইসলামবিদ্বেষের প্রসার ঘটছে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার উর্বরভূমি উত্তর প্রদেশে আদিত্যনাথের ক্ষমতারোহণ ইঙ্গিত দেয় যে সেই ইসলামবিদ্বেষ আরও গভীর হচ্ছে। উত্তর প্রদেশে নির্বাচনী সাফল্যের জন্য অবশ্য প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (সূত্র: আমেরিকানবাজার অনলাইন ডট কম)। আর আদিত্যনাথও চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো মুসলমানদের ওপর ভারত ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, যাতে তাঁর ভাষায় ‘সন্ত্রাসীরা’ তাঁর দেশে ঢুকতে না পারে (সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সম্পাদকীয়, ১৯ মার্চ, ২০১৭)।
উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী সাফল্যের কারণে ইতিমধ্যেই আওয়াজ উঠেছে, ২০১৯ সালের নির্বাচনেও মি. মোদি ক্ষমতায় ফিরবেন। নিউইয়র্ক টাইমস তার সম্পাদকীয়তে এই সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেছে, মি. মোদির বিজেপির মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে যে তাঁদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরের পথে আর কোনো প্রতিবন্ধক নেই। ভারত সরকার অবশ্য ওই সম্পাদকীয় মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিজেপির এই আত্মবিশ্বাসের আরও একটা কারণ হচ্ছে সর্বভারতীয় বিরোধী দল হিসেবে এখন একক কোনো দল আর বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বী নয় এবং আঞ্চলিক দলগুলোর সমন্বয়ে বৃহত্তর জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিজেপির ওপর কট্টরপন্থীদের চাপ এবং নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়বে। গার্ডিয়ান–এর ভাষায়, দেশটির সংখ্যালঘুদের হয়তো সংখ্যাগুরুদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। উত্তর প্রদেশে তার আলামতও এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। কসাইখানাগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের ওপর এখন ফৌজদারি অপরাধের চেয়েও বড় দায়িত্ব রোমিওদের (প্রেমিকপ্রবণ তরুণ) ওপর নজরদারি। আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিএসপির একজন মুসলমান সাবেক রাজ্য বিধায়ক উগ্রপন্থীদের হামলায় নিহত হয়েছেন।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার দেশটিতে সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেন এসব উদ্বেগ? ভারতের মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে মুসলমান। অর্থাৎ, ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ২৬ কোটি মুসলমান। উত্তর প্রদেশেও অনুপাতটি প্রায় একই রকম—১৮ শতাংশ। কিন্তু ভারতের ৫৪৫ আসনের লোকসভায় মুসলমান সাংসদ আছেন এখন মাত্র ২২ জন এবং তাঁদের মধ্যে বিজেপির কেউ নেই। একইভাবে উত্তর প্রদেশের রাজ্য বিধানসভাতেও এবার বিজেপি কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও কংগ্রেস মিলিয়ে ৪০৩ আসনের মধ্যে মাত্র ২৭ জন মুসলমান এবার সেখানে বিধায়ক হয়েছেন। গতবার এই সংখ্যা ছিল ৬৮। রাষ্ট্রকাঠামোয় সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এসব পরিসংখ্যান খুবই হতাশাজনক। ১৯৮০ সালে লোকসভায় রেকর্ড ৪৯ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেটিও জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে যতগুলো হওয়ার কথা, তার অর্ধেক।
ভারতীয় ঐতিহাসিক ও লেখক রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং গোলমেলে সময়, যখন প্রান্তিক বিষয় মূলধারায় চলে আসে। এই গোলমেলে সময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতার কথা বারবারই আসবে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের টিকে থাকা যদি সংখ্যাগুরুদের সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে চাপিয়ে দেওয়া শান্তিও টেকসই হয় না। কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পক্ষে গণরায়কে অস্বীকার বা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, এ কথা ঠিক। তবে রাষ্ট্রের চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখা, সংখ্যালঘুর সাংবিধানিক গ্যারান্টি এবং মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলোর প্রশ্নে ভারতের উদারপন্থীরা আরও সোচ্চার হবেন, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। তবে প্রতিবেশী হিসেবে আমরাও যে বেশি দিন চোখ বন্ধ রাখতে পারব, তেমনটিও ভাবার কোনো কারণ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান স্বদেশেও যেমন বিপজ্জনক, অন্য দেশেও তা কম নয়।
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
পাঠকের মন্তব্য