সিলেটের টিলাগড় এলাকার শাপলাবাগের ‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’র কথা অনেকের নিশ্চয়ই মনে থাকবে। আজ থেকে ১১ বছর আগে ২০০৬ সালের ২রা মার্চ এই ভবনটি থেকে সপরিবারে আটক করা হয়েছিল জেএমবি নামক জঙ্গি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আব্দুর রহমানকে।
তারই মাস ছয়েক আগে, একযোগে সারা বাংলাদেশের তেষট্টিটি জেলায় ৫শটি’র মত বোমা হামলা চালিয়ে চমকে দিয়েছিল এই জেএমবি।
‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’ থেকে শায়খ রহমানকে বের করে আনতে সময় লেগেছিল ৩ দিন।
র্যাব বাড়িটিকে ঘেরাও করে রেখেছিল আটাশে ফেব্রুয়ারি থেকে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত সবাইকে জীবিতই আটক করা গিয়েছিল।
শায়খ রহমানকে তার নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কারণে এর এক বছর পর ২০০৭ সালের ৩০শে মার্চ ফাঁসীতে চড়তে হয়েছিল।
কথিত আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই শায়খ রহমানকেই বাংলাদেশে ‘জিহাদের’ প্রবক্তা বলে মনে করে, এক নিবন্ধে এমন দাবী করেছে আইএসের সাময়িকী ‘দাবিক’।
২০০৬ সালে সিলেটের ওই অভিযানকেই মনে করা হয় বাংলাদেশের প্রথম বড় ধরণের জঙ্গিবিরোধী অভিযান, যেটা চলেছিল কয়েকদিন ধরে এবং সফলতা পেয়েছিল পুলিশ।
সেবার শায়খ রহমানকে পরিবারের সব সদস্য-সহ বের করে আনতে প্রয়োগ করা হয়েছিল গ্যাস।
‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’র ছাদ ফুটো করে ক্যামেরা ঢুকিয়ে ভিতরের কর্মকাণ্ড অবলোকন করেছিল র্যাব সদস্যরা।
সেবারের সেই অভিযান আধুনিক যোগাযোগ যন্ত্রপাতির কল্যাণে টেলিভিশনে সরাসরি দেখেছিল সারা বাংলাদেশের মানুষ।
ওই ঘটনার এগারো বছর পর সেই শাপলাবাগ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আরেক বাড়ি ‘আতিয়া মহলে’ একই রকম কয়েকদিন ব্যাপী আরেক জঙ্গি বিরোধী অভিযান দেখল সিলেটবাসী এবং বিশ্ববাসী।
আতিয়া মহলে যখন এই অভিযান চলছে, তখন টিলাগড়ের সেই ‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’তে গিয়ে দেখা গেল, নতুন রং করা হয়েছে বাড়িতে। সংস্কারও করা হয়েছে।
এগারো বছর আগের সেই ধ্বংস যজ্ঞের কোন চিহ্নই নেই। বাড়িতে রয়েছে নতুন ভাড়াটিয়া।
পরিবর্তন কতটা?
যদিও এবার সেবারকার মতো গণমাধ্যমকে আশপাশে ভিড়তে দেয়া হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলও বদলেছে অনেক।
এখন এ ধরণের যে কোন অভিযান চলাকালেই গণমাধ্যমগুলোকে ‘সরাসরি সম্প্রচার’ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আর এ কদিনের অভিযানে ওই এলাকায় যে পরিমাণ গুলি-গোলা ও বোমার বিস্ফোরণ হয়েছে, অনেকেই এটাকে মধ্যপ্রাচ্যের কোন রণাঙ্গন বলে ভুল করতে পারেন।
এমনকি আতিয়া মহলের দেয়াল ভাঙতে কমান্ডোরা রকেট লঞ্চার পর্যন্ত ব্যবহার করেছে, সেকথা জানিয়েছে খোদ সেনাবাহিনী।
এর আগেও ঢাকার কল্যাণপুর, উত্তরা কিংবা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গি বিরোধী অভিযান চলাকালে সাংবাদিকদের কাছে ভিড়তে দেয়া হয়নি।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, “তাদের টেকনিকে খুব একটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না, কিন্তু তাদের ইন্টেলিজেন্সে একটু উন্নতি হয়েছে বলে আমি মনে করি।”
“টেকনিক বলতে যেটা বোঝা যায়, সেটা যদি পরিবর্তন হত, তাহলে হয়তো এই এত লোক মারা গেলো আরো চল্লিশ জন আহত হল, সেটা অ্যাভয়েড করা যেত”।
তবে মি. হোসেন এগারো বছর আগের জঙ্গিদের সঙ্গে এখনকার জঙ্গিদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখেন।
“শায়খ আব্দুর রহমানরা ফ্যামিলিসুদ্ধ ওইখানে ছিল। তাদের সবাই চিনতো জানতো। সে একটা নজরদারীর মধ্যে ছিল। তারা ওই ধরনের মোটিভেটেড ছিল না যে তারা আত্মহননের মত কাজ করবে। এখন যেরকম দেখা যাচ্ছে সেরকম কোন অস্ত্র কিংবা বিস্ফোরকও তাদের কাছে ছিল না।”
“কিন্তু এখন যারা হচ্ছে, তাদেরকে আমি বলি ফেসলেস। তাদের সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। এরা অত্যন্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যেটা দেখলাম, গ্রেনেড ছুড়ে মারতে তারা রেডি। এবং বিভিন্ন জায়গায় আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তারা লাগিয়েছে, তার মানে কেউ অ্যাপ্রোচ করলে নিজেদেরকেও তারা উড়াবে এবং বিল্ডিংটাকেও উড়িয়ে দেবে”, বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন।
কিন্তু ২০০৬ সালে সূর্যদীঘল বাড়ির অভিযানটি হয়েছিল বিনা রক্তপাতে। সামান্য কিছু বিস্ফোরক পাওয়া গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেগুলো এখনকার মতো বিধ্বংসী ছিল না।
পাঠকের মন্তব্য