চট্টগ্রামে নিখোঁজ আটজনের একজন ইরাকে বাকিরা ‘জঙ্গি তৎপরতায়’

প্রতিকী চিত্র।
প্রতিকী চিত্র।

তাঁদের কেউ নয় মাস কেউবা দুই বছরের বেশি সময় ধরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন পরিবার জানে না। এ রকম আটজনের একটি তালিকা করেছে চট্টগ্রামের পুলিশ। নিখোঁজ ব্যক্তিরা ‘জঙ্গি তৎপরতায়’ জড়িয়ে পড়েছেন বলে ধারণা করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তাঁদের মধ্যে একজন ইরাক চলে গেছেন বলে পরিবার ও পুলিশ নিশ্চিত করেছে।

গত বছরের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর চট্টগ্রাম নগর ও জেলা পুলিশ নিখোঁজ ব্যক্তিদের পৃথক দুটি তালিকা করে। দুই তালিকায় প্রায় ৩০০ জনের নাম ছিল। তালিকার বেশির ভাগ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত জেলায় ছয়জন এবং নগরের দুই যুবকের কোনো হদিস পাচ্ছে না পুলিশ।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের করা তালিকায় নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিরা হলেন ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার বাসিন্দা শাহজাহান, হাটহাজারীর অর্পণ চৌধুরী, মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানার রুবেল ও ইমরানুল ইসলাম ওরফে শিহাব, চন্দনাইশ উপজেলার আসিফ আদনান ও জসিম। এ ছাড়া নগরের ইপিজেড এলাকার মো. নজিবুল্লাহ আনসারী ও বাকলিয়া এলাকার সাব্বিরুল হক।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ সাতজনের একটি তালিকা তাঁদের কাছে রয়েছে। ওই তালিকায় থাকা নিয়াজ মোরশেদ নামের এক যুবক সম্প্রতি সিরিয়ায় আত্মঘাতী হামলায় মারা গেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, তালিকার বাকি ছয়জন সম্পর্কে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই ছয়জন জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছেন বলে সন্দেহ করছেন তাঁরা।

নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে নজিবুল্লাহ আনসারী ইরাকে জঙ্গি সংগঠন আইএসে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তাঁর ভাইয়ের কাছে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ওই বার্তায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আইএসে যোগদানের জন্য ইরাকে চলে এসেছি। আমি আপনাদের সাথে কোনো দিন যোগাযোগ করব না। কোনো দিন দেশে ফিরব না।’ নজিবুল্লাহ পেশায় মেরিন প্রকৌশলী। তাঁর বাবা মো. রফিকুল্লাহ আনসারী নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। ছেলে নিখোঁজ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে গত বছরের ১০ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি।

জিডিতে বলা হয়, ২০১২ সালে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিদেশি জাহাজে চাকরি নেন নজিবুল্লাহ। সর্বশেষ মালয়েশিয়া থেকে জাহাজে উঠে ইরাকে চলে যান। নজিবুল্লাহ আইএসে যোগ দেন বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়।

রফিকুল্লাহ আনসারী গত শনিবার মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার ছেলে ইরাকে চলে যাওয়ার পর থেকে কোনো খবর নেই।’

এ বিষয়ে ইপিজেড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহেদ উল্লাহ মুঠোফোনে বলেন, ‘নজিবুল্লাহ ঘোষণা দিয়ে ইরাকে চলে গেছেন। তিনি জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছেন।’

ফটিকছড়ির বাসিন্দা শাহজাহান গত বছরের ৭ মে থেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে পুলিশ ও পরিবার জানায়। তিনি নগরের একটি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। নিখোঁজ হওয়ার পর কিছুদিন পর নগরের ডবলমুরিং থানায় তাঁর পরিবার একটি জিডি করে।

শাহজাহানের ভাই মোহাম্মদ আলী বলেন, তাঁর ভাই চট্টগ্রাম শহরের ডবলমুরিং এলাকায় থাকতেন। শাহজাহান বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। ঋণের ভার সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

অবশ্য শাহজাহান আত্মহত্যা করেছেন এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছে নেই। জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আত্মহত্যা করে থাকলে লাশ কোথায় গেছে?

চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাব্বিরুল হক গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁর বাবা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগে চাকরি করেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলায় হলেও পরিবার নিয়ে নগরের বাকলিয়া এলাকায় বসবাস করেন। গত বছরের জুলাই মাসে রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নয় জঙ্গি নিহত হয়। তখন সাব্বিরুল নিহত হন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পরে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।

গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলে সাব্বিরুল তাঁর বাবার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যান।

সাব্বিরুলের বাবা আজিজুল হক বলেন, ‘সাব্বিরুল বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। পুলিশ অনেক চেষ্টা করে আমার ছেলের সন্ধান বের করতে পারেনি।’

চন্দনাইশ উপজেলার বাসিন্দা আসিফ আদনানের অবস্থান সম্পর্কে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের কাছে কোনো তথ্য নেই। ২০১০ সালে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আদনান একবার ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিল বলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান। জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।

আসিফ আদনানের চাচা সিরাজুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘সে (আসিফ আদনান) কোথায় আছে আমার জানা নেই।’

চন্দনাইশের হাশিমপুর এলাকার আরেক বাসিন্দা মো. জসিম চার বছর ধরে এলাকায় নেই। তিনি স্থানীয় হাসানদণ্ডী এম রহমান সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জসিম জড়িত ছিলেন। এখন কোথায় রয়েছেন, তা জানেন না তাঁরা।

নাম না প্রকাশের শর্তে জসিমের এক আত্মীয় বলেন, এলাকা ছেড়ে দীর্ঘদিন বান্দরবানে ছিলেন জসিম। এরপর ঢাকায় চলে যান। জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকতে পারে বলে তিনি সন্দেহ করেন।।

জসিমের বাবা নেই। তাঁর বাবার চাচাতো ভাই মো. শরীফ উদ্দিন ভাতিজার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানাধীন মধ্যম সোনাপাহাড় এলাকার দুই যুবক রুবেল ও ইমরানুল ইসলাম সম্পর্কেও কোনো তথ্য জেলা পুলিশের কাছে নেই। ২০১৪ সালের জুন থেকে তাঁরা নিখোঁজ রয়েছেন।

জোরারগঞ্জ থানা-পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, জনশ্রুতি আছে যে দুই যুবক জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত।

হাটহাজারীর বাসিন্দা অর্পণ চৌধুরী নামের আরেক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁর বিষয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বলেন, অর্পণ ধর্মান্তরিত মুসলমান। জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকতে পারে বলে তাঁরা সন্দেহ করছেন।

সর্বশেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৭, ০২:০৩
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন