অভিযান শুরুর চারদিন পর জঙ্গিমুক্ত সিলেটের আতিয়া মহল

সিলেটের শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহল থেকে গতকাল অভিযানের সময় ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। ছবিটি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তোলা lAnis Mahmud
সিলেটের শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহল থেকে গতকাল অভিযানের সময় ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। ছবিটি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তোলা l
জঙ্গিরা আতিয়া মহলের নিচতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে আস্তানা গড়ে তুলেছিল। এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চার দিন ধরে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ, সোয়াট এবং সর্বশেষ সেনাবাহিনী।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার মানুষের গতকাল সকালে ঘুম ভাঙে গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দে। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আবার কয়েকটি বিকট বিস্ফোরণ হয়। আতিয়া মহল থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এরপর থেকেই সব শান্ত। চার ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী জানাল, ওই বাড়ির ভেতরে থাকা চার জঙ্গি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী।

এঁদের মধ্যে দুজন আগের দিন রোববার কমান্ডোদের গুলিতে নিহত হয় বলে ওইদিন সেনাবাহিনী জানিয়েছিল। বাকি এক নারী ও পুরুষ এর আগে না পরে নিহত হয়েছে, সে সম্পর্কে গতকাল কিছু বলা হয়নি।

এই জঙ্গিরা আতিয়া মহলের নিচতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে আস্তানা গড়ে তুলেছিল। এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চার দিন ধরে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ, সোয়াট এবং সর্বশেষ সেনাবাহিনী।

গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সেনা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আতিয়া মহলে আর কোনো জঙ্গি জীবিত নাই। সবাই অভিযানে নিহত হয়েছে।’ তিনি বলেন, সেখান থেকে একজন নারী ও একজন পুরুষের মৃতদেহ বের করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও দুটি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, যাদের শরীরে সুইসাইডাল ভেস্ট (আত্মঘাতী হামলার জন্য বিস্ফোরকভর্তি বন্ধনী) বাঁধা। এ কারণে অভিযান শেষ হচ্ছে না। আতিয়া মহলের ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলেও সেখানে প্রচুর বিস্ফোরক বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

নিহত চার জঙ্গির পরিচয় গতকাল জানা যায়নি। ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, ‘নিহতদের মধ্যে শীর্ষ কোনো জঙ্গি আছে কি না, এখনো নিশ্চিত করে আমি বলতে পারছি না। সেই আইডেন্টিফিকেশন প্রসেস চলবে। পুলিশ-র‍্যাব তাদের নমুনা সংগ্রহ করে নিশ্চিতভাবে বলবে। আমাদের কাছে তথ্য ছিল চারজনের বিষয়ে, সেই চারটি ডেড বডি আমরা পেয়েছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় দুই বাসিন্দা বলেন, এর আগে গত রোববার দিবাগত রাতেও থেমে থেমে গুলি হয়েছে। সকালে তাঁদের ঘুম ভেঙেছে গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দে। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের কিছু পরে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেও দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে প্রায় ২০ মিনিট থেমে থেমে চলে গুলি। ১২টা ৪০ মিনিটের পর ২টা পর্যন্ত কোনো গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়নি। বেলা ২টায় শক্তিশালী বিস্ফোরণে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। এরপর থেকে ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। প্রায় এক ঘণ্টা পর ৩টা ১৮ মিনিটের দিকে পুনরায় বিস্ফোরণ হয়। ৩টা ৩৫ মিনিটে আতিয়া মহল থেকে কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে বের হয়। এরপর আর কোনো গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়নি।

সবশেষ গুলি ও বিস্ফোরণের চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আতিয়া মহলের কাছে পাঠানপাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনী। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, আতিয়া মহলের একটি ঘরে দুটি লাশ পড়ে রয়েছে। লাশের শরীরে বিস্ফোরকভর্তি সুইসাইডাল ভেস্ট বাঁধা। এর চারদিকে চার-পাঁচটি বিস্ফোরক (আইইডি) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। এগুলো সরানো ঝুঁকিপূর্ণ, তাই অভিযান শেষ না করে আরও কিছু সময় নেওয়া হচ্ছে। অভিযান শেষ করে ক্রাইম সিন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তিনি বলেন, ‘পুরো বিল্ডিংয়ে যে পরিমাণ এক্সপ্লোসিভ আছে, এগুলো যদি ফাটে, এক্সপ্লোশন হয়, বিল্ডিংয়ের অংশবিশেষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পুরো বিল্ডিংটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হচ্ছে।’

এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, আতিয়া মহলে ঢোকার মুখে একটা বড় বালতির মধ্যে জঙ্গিরা বিস্ফোরক রেখেছিল। সেগুলোর যখন তারা বিস্ফোরণ ঘটায়, তখন কলাপসিবল গেট উড়ে এসে পাশের ভবনে পড়েছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় কয়েকজন সেনাসদস্য ছিটকে পড়েন। তবে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কেউ হতাহত হননি। তিনি বলেন, ‘যে চারজন (জঙ্গি) এখানে ছিল, তারা ওয়েল ট্রেইনড। তাদের খুঁজে বের করে যে নিষ্ক্রিয় করা হলো বা হত্যা করা হলো, এটা আমাদের জন্য, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর জন্য বড় সফলতা। আমাদের অপারেশন এখনো চলমান আছে।’

ভবন থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার কারণ সম্পর্কে সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘যে পরিমাণ ফায়ারিং, গ্রেনেড লঞ্চ করা হচ্ছে, তাতে ভবনে থাকা মানুষের লেপ-তোশক, বালিশে আগুন লাগতেই পারে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়েছি। আগুন লাগলে আরও বিপজ্জনক হতে পারত।’

ওই সংবাদ সম্মেলনের পর সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রোকনউদ্দীন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিন মাসে ওই বাড়িতে এত বিস্ফোরক জড়ো করা হলো, এতে পুলিশের নজরদারির কোনো গাফিলতি রয়েছে কি না, জানতে চাইলে রোকনউদ্দীন বলেন, ‘এখানে পুলিশের কোনো গাফিলতি নেই। এই শহর তো আর পুরোটা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন নয়। তা ছাড়া তারা বিভিন্ন সময়ে অল্প অল্প করেই এসব বিস্ফোরক জড়ো করেছে বলে মনে হয়।’

গতকাল চতুর্থ দিনের অভিযান চলাকালে আতিয়া মহলের আশপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। আতিয়া মহল ঘিরে তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তাটিতে চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকবে।

আতিয়া মহল নামের পাঁচতলা এই বাড়িটি গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় ঘিরে ফেলে পুলিশ। শুক্রবার ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট গিয়ে অভিযানে অংশ নেয়। এরপর শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের মধ্যেই শনিবার সন্ধ্যায় দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন নিহত এবং আরও ৪৪ জন আহত হন। স্মরণকালের মধ্যে এটা সবচেয়ে দীর্ঘ জঙ্গিবিরোধী অভিযান।

সর্বশেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৭, ০২:০৯
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন