প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে গণহত্যার বিবরণ কি হয়েছিলো ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকার জগন্নাথ হলে?

পারিবারিক অ্যালবামে কালীরঞ্জন শীলের ছবি দেখছেন স্ত্রী হিরণ্ময়ী দাশ, মেয়ে প্রীতিলতা শর্মা ও নাতি সূর্য সেন। ছবিটি গত শনিবার মহিলা পরিষদ মিলনায়তন থেকে তোলা (বামে)। কালীরঞ্জন শীল (ডানে)।Sabina Yasmin
পারিবারিক অ্যালবামে কালীরঞ্জন শীলের ছবি দেখছেন স্ত্রী হিরণ্ময়ী দাশ, মেয়ে প্রীতিলতা শর্মা ও নাতি সূর্য সেন। ছবিটি গত শনিবার মহিলা পরিষদ মিলনায়তন থেকে তোলা (বামে)। কালীরঞ্জন শীল (ডানে)।
‘কতগুলো লাশ এভাবে বহন করেছি, ঠিক মনে নেই। তবে শেষ যে লাশটি টেনেছিলাম, সেটি ছিল দারোয়ান সুনীলের। তাঁর শরীর তখনো গরম ছিল। অল্পক্ষণ আগে মরার কারণে কিংবা রোদে থাকার কারণেও হতে পারে।’

‘সত্যি কি আমি জীবিত? আমার সাথে যারা ছিল…এইত কিছু আগে একসাথে লাশ কুড়িয়েছি, টেনে টেনে এক স্থানে জড়ো করেছি—তারা সবাই…মরে গেল, আর আমি বেঁচে আছি—এ কী করে সম্ভব?’

এই হতবিহ্বল প্রশ্ন সারা জীবনই তাড়া করে ফিরেছে কালীরঞ্জন শীলকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ২৫ মার্চের গণহত্যা যাঁরা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো নিঃসন্দেহে আরেক কঠিন যুদ্ধ ছিল।

‘মাঝে মাঝে খাবার খেতে গিয়ে ও ভাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠত “এ রকম একটা ঘটনার পরও বেঁচে আছি। ভাত খাচ্ছি। কথা বলছি। এটা তো অবাক একটা ব্যাপার,”’ বলেন কালীরঞ্জন শীলের স্ত্রী হিরণ্ময়ী দাশ, সবার কাছে যিনি রুনুদি নামে পরিচিত। সঙ্গে তাঁর কথা হচ্ছিল গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায়, মহিলা পরিষদের অফিসে।

একাত্তরের কালরাতের এই স্মৃতি কালীরঞ্জন শীল লিখে রেখেছেন ‘জগন্নাথ হলেই ছিলাম’ নামে এক মর্মস্পর্শী বিস্ময়কর স্মৃতিচারণায়। ১৯৮৯ সালে সেটি প্রকাশিত হয় রশীদ হায়দার সম্পাদিত ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বইতে। এতে যে লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বিবরণ ফুটে উঠেছে, ভয়াবহতার দিক থেকে এর নজির পাওয়া কঠিন।

জগন্নাথ হলে মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ এবং সারা রাত ধরে নির্বিচারে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা দেখেছেন কালীরঞ্জন শীল। তখন তিনি জগন্নাথ হলের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। থাকতেন হলের দক্ষিণবাড়ি ভবনে (এখন যেটা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরদা ভবন)। সারা রাত হলের বাথরুম ও তিনতলার কার্নিশে লুকিয়ে থেকে তিনি এসব দেখেছেন। ভোরবেলায় ধরা পড়েন সেনাসদস্যদের হাতে।

সেনাসদস্যরা তখন বিভিন্ন ভবন থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের লাশ বহন করাচ্ছিল বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের দিয়ে। কালীরঞ্জনকেও তারা এ কাজে ব্যবহার করে। কালীরঞ্জন একের পর এক লাশ জড়ো করেছেন। বয়ে নিয়ে গেছেন হলের মাঠের দিকে।

কালীরঞ্জন তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘যখন দুজনে এক একটি লাশ নিচ্ছিলাম, তখন আমাদের সামনে-পিছনে দুজন করে মিলিটারি ছিল। লাশগুলো নিয়ে আমরা অ্যাসেম্বলি (হলের) সামনের রাস্তা দিয়ে সোজা পূর্ব দিকের গেটের বাইরে চলে গেলাম…উত্তরবাড়ির সামনের শহীদ মিনারের কাছে লাশগুলো রাখতে বলল। পূর্বেই সেখানে অনেক লাশ জড়ো করা ছিল…দুজন-তিনজন করে এক একটি লাশ বহন করছিলাম। ক্লান্ত হয়ে কোনো জায়গায় একটু জিরিয়ে নিতে চাইলে গুলি করবে বলে মিলিটারি তেড়ে আসত।’

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, লাশ বহনের এই দৃশ্যটির সাক্ষাৎ দলিল আছে ভিডিও ফুটেজের আকারে। ঠিক ওই মুহূর্তে জগন্নাথ হলের উল্টোদিকে ফুলার রোডে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে বুয়েট) অধ্যাপকদের জন্য তৈরি চারতলার এক ফ্ল্যাট থেকে এক শৌখিন ক্যামেরায় গোপনে দৃশ্যটি ধারণ করছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল উলা। সারা বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাসের এ এক বিরল দলিল—বলেছেন ভারতীয় সাংবাদিক অমিতা মালিক। অমিতা মালিক ঢাকায় বসে এই ফুটেজ দেখেছেন ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পর। ২০ মিনিটের এই ফুটেজ দেখে শিউরে উঠেছেন অমিতা। ওরিয়েন্ট লংম্যানস থেকে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত দ্য ইয়ার অব দ্য ভালচার্স বইতে অমিতা এই ফুটেজ দেখার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: ‘প্রথম দেখা গেল দূর থেকে ছোট ছোট কতগুলো মানবশরীর লাশ বয়ে নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে আসছে। সেগুলো সম্ভবত জগন্নাথ হলে গণহত্যার শিকার ছাত্র ও শিক্ষকদের লাশ।…এদের পেছনে উদ্ধত ভঙ্গিতে তাড়া দিতে দিতে আসছে কালো পোশাকের কিছু লোক, এরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্বৃত্ত।’

কালীরঞ্জন শীল তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘কতগুলো লাশ এভাবে বহন করেছি, ঠিক মনে নেই। তবে শেষ যে লাশটি টেনেছিলাম, সেটি ছিল দারোয়ান সুনীলের। তাঁর শরীর তখনো গরম ছিল। অল্পক্ষণ আগে মরার কারণে কিংবা রোদে থাকার কারণেও হতে পারে।’

এ রকমই লাশ কুড়াতে কুড়াতে কালীরঞ্জন দেখেছিলেন দার্শনিক-শিক্ষক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের মরদেহ। কালীরঞ্জন লিখেছেন, ‘সামনেই দেখি ড. দেবের মৃতদেহ, ধুতি পরা, খালি গা। ক্ষতবিক্ষত শরীর। পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে।’

তবে কালীরঞ্জনের অভিজ্ঞতার সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়টির সূচনা তখনো বাকি। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ তখনো শেষ করেনি। কালীরঞ্জনের বর্ণনায়: ‘বুঝলাম এবার আমাদের পালা। আমাদের আগে যারা লাশ নিয়ে পৌঁছেছিল, তাদেরও দাঁড় করিয়েছে।’

ভোরের আলোয় ছাত্রদের একে একে ধরে এনে গুলি করে মারার এই দৃশ্যও ধরা পড়েছে নূরুল উলার জাপানি ক্যামেরায়। পরে এক স্মৃতিচারণায় এই ভয়াবহ দৃশ্যের বিবরণ দিতে গিয়ে নুরুল উলা লিখেছেন, ‘জীবনে এই প্রথম স্বচক্ষে মানুষ মারা দেখলাম, আর সেটাও আহত লোককে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে…লোকগুলোর কাছে নিয়ে এসে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ধরল। তারপর শুরু হলো গুলি, অনেকটা এলোপাতাড়ি। কেউ বসে ছিল, কেউ দাঁড়িয়ে, তাদের ওপর সামনে, বেশ কাছাকাছি থেকে গুলি চালাচ্ছে। আর পেছন থেকে উঠছে ধূলি। বুঝলাম গুলি দেহ ভেদ করে মাটিতে ঠেকছে। মাঠের ওপর পড়ে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকল।’

কালীরঞ্জন শীল বেঁচে যান। লাশ বহন করতে করতে ক্লান্তিতে ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের লাশের পাশে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। ফলে তাঁকেও মৃত ভেবে নেওয়া হয়েছিল।

বেশ পরে, এই হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানি বাহিনী চলে গেলে কালীরঞ্জন উঠে হল থেকে বেরিয়ে আসেন। বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে তিনি কেরানীগঞ্জে চলে যান। সেখান থেকে প্রথমে নবাবগঞ্জ ও পরে নিজ গ্রাম বরিশালের উজিরপুরে নিজ এলাকায় পৌঁছান এপ্রিলের মাঝামাঝি।

একপ্রকার হেঁটে ধামুড়া গ্রামে পৌঁছেছিলেন কালীরঞ্জন। মাঝরাতে গিয়ে যে বাড়ির দরজায় কড়া নেড়েছিলেন, সেটি ছিল হিরণ্ময়ী দাশের বাড়ি। এই হিরণ্ময়ী তখন গৌরনদী কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির প্রথম বর্ষের ছাত্রী, আট বছর পর যিনি হবেন কালীরঞ্জনের স্ত্রী।

হিরণ্ময়ী এখন মহিলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নিজের বেঁচে থাকাটাকে আকস্মিক দৈব ঘটনা হিসেবে দেখতেন কালীরঞ্জন। ওই দিনের পর থেকে জীবনটাকে তিনি সেভাবেই নিয়েছেন। ভীষণ মানবিক আর পরোপকারী ছিলেন কালীরঞ্জন। যে কারও বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতেন।

স্বাধীন দেশে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পূর্ণকালীন নেতৃস্থানীয় কর্মীর দায়িত্ব পালন করেছেন কালীরঞ্জন। বাংলাদেশ-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী সমিতির দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

১৯৯৯ সালে তিনি মারা যান। বড় মেয়ে মৈত্রী দেবী দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। ছোট মেয়ে প্রীতিলতা শর্মা বলেন, জগন্নাথ হলের ওই ভয়াবহ স্মৃতির কথা খুব বেশি বলতেন না তাঁর বাবা। তবে ওই স্মৃতিই হয়তো তাঁর চরিত্রে এক ভিন্ন রকম দৃঢ়তা এনে দিয়েছিল। জগতের সবকিছুকে শান্ত, ধীরতার সঙ্গে গ্রহণ করার সামর্থ্য তৈরি করে দিয়েছিল।

সর্বশেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৮, ০১:০০
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন