বারুদে ঠাসা সিলেটের আতিয়া মহল

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল বলেন, ‘আমরা যে গ্রেনেড মেরেছি, তারা সেই গ্রেনেড কুড়িয়ে আমাদের দিকেই ছুড়ে মেরেছে। টিয়ার গ্যাস মারলে আগুন জ্বালাচ্ছে। বোঝা যায়, এসব কৌশল প্রয়োগে তারা অভ্যস্ত। আর যেভাবে উচ্চশক্তির বিস্ফোরক ঘরে লাগিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা যথেষ্ট জ্ঞান রাখে যে কীভাবে পরিবেশকে অভিযানকারীদের কাছে দুর্গম করে তুলতে হয়।

সিলেটের আতিয়া মহলে অভিযানের তৃতীয় দিন গতকাল রোববার ভেতরে থাকা জঙ্গিদের মধ্যে দুজন নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনী বলেছে, ওই জঙ্গি আস্তানায় আরও এক বা একাধিক জঙ্গি থাকতে পারে। জঙ্গিরা এতই দক্ষ যে সেনাবাহিনীর ছুড়ে দেওয়া গ্রেনেড কুড়িয়ে নিয়ে পাল্টা সেনাবাহিনীর দিকেই ছুড়ে দিচ্ছে। পাঁচতলা বাড়িটির ভেতরে প্রচুর বোমা-বারুদ (আইইডি) পেতে রাখা হয়েছে। এতে পুরো ভবনটি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে আছে। এ কারণে ধীরগতিতে অভিযান চালাতে হচ্ছে।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার এই বাড়িটি গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে। শুক্রবার ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট সিলেটে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থল ঘেরাও করে। এরপর শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের মধ্যেই শনিবার সন্ধ্যায় দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন নিহত এবং আরও ৪৪ জন আহত হন। স্মরণকালের মধ্যে এটা সবচেয়ে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী জঙ্গিবিরোধী অভিযান।

জঙ্গিদের পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার ধারণা। তবে গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে পুলিশ স্পষ্ট কোনো ভাষ্য দেয়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেন, আজ সোমবার নাগাদ অভিযান শেষ হতে পারে। প্রাণহানি যাতে না ঘটে, সে জন্য সেনাবাহিনী সময় নিচ্ছে। তারা কোনো ঝুঁকি নিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে আগে থেকেই গোয়েন্দা তথ্য ছিল, ওই বাড়িতে জঙ্গি আছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত করতে গিয়েই এই আস্তানা খুঁজে পেয়েছে। এরপরই আমরা অভিযান চালাচ্ছি।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। তবে ভেতরে আরও জঙ্গি মৃত ও জীবিত থাকতে পারে। সেখানে প্রচুর বিস্ফোরকও আছে।
শনিবারের সন্ধ্যায় বোমা বিস্ফোরণ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে যখন শিববাড়ির ওই সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানাটি নিরাপত্তা বাহিনী ঘেরাও করে ফেলে, তখনই বোধ হয় কোনো এক সময় এখানে আশপাশে তারা বোমাটি পেতে রেখে গিয়েছিল বা আগেই রেখে গিয়েছিল। পুলিশরা যখন দেখেছে, তখনই এটা বিস্ফোরিত হয়েছে ধাক্কা-ধোক্কা খেয়ে।’

আতঙ্কের সিলেট, অভিযান এলাকায় নিষেধাজ্ঞা
শনিবার সন্ধ্যায় নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যেই বোমা হামলা বা বিস্ফোরণের কারণে গতকাল নিরাপত্তা চৌহদ্দি বাড়ানো হয়েছে। আতিয়া মহল ঘিরে দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পুলিশ। শনিবার সেনাবাহিনীর অভিযানের আগে ওই এলাকার গ্যাস-সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আতিয়া মহলসহ আশপাশের বাড়ির বিদ্যুৎ-সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ অন্যত্র সরে গেছেন। বাকিরা নিজ নিজ বাড়িতেই ছিলেন। সেখানকার দোকান, কারখানা, যান চলাচল—সবই বন্ধ রয়েছে। ওই বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে রেললাইন। ট্রেন চলেছে স্বাভাবিকভাবে। ওই হামলার পরে গতকাল পুরো সিলেট ছিল আতঙ্কিত। স্বাধীনতা দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও লোকসমাগম ছিল অন্যবারের তুলনায় কম।

অভিযানস্থল থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে গতকাল সকাল থেকে চারটি বিকট বিস্ফোরণ এবং বিকেল চারটা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা গেছে। এর মধ্যে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে দু-তিন কিলোমিটার দূরের মাটি পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। পরে ঘটনাস্থলে থাকা একজন পুলিশ সদস্য বলেন, তিনি আতিয়া মহল বাড়িটির দেয়াল থেকে প্লাস্টার খসে পড়তে এবং কিছু অংশ ধসে যেতে দেখেছেন।

পরে গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে সেনা সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, অভিযানের সুবিধার্থে বিস্ফোরক দিয়ে একটি দেয়াল ফেলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গিদের একজন নিজের শরীরে বাঁধা আত্মঘাতী বেল্ট বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলন
আতিয়া মহল থেকে দুই শ গজের মধ্যে পাঠানপাড়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে অভিযানের বিষয়ে জানাতে গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনী।
সংবাদ সম্মেলনে সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, সেনা কমান্ডোদের অভিযানে আতিয়া মহলে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। বাড়িটির নিচতলায় প্রচুর বিস্ফোরক (আইইডি) পেতে রেখেছে জঙ্গিরা। যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা ভবনে নিজেদের রক্ষা করে সতর্কতার সঙ্গে অভিযান চালাতে হচ্ছে। অভিযান কবে শেষ হবে, তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না।

ফখরুল আহসান বলেন, আতিয়া মহলের বাসিন্দাদের উদ্ধার করা ছিল তাঁদের প্রথম লক্ষ্য। সে কাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ হয়েছে। এখন তাড়াহুড়ো নেই।
ফখরুল আহসান বলেন, সেনাবাহিনী রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে গর্ত তৈরি করেছে। কিন্তু ওই পদ্ধতি কোনো কাজে লাগেনি। এরপর ভেতরে কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করা হয়। তখন জঙ্গিদের পক্ষে সেখানে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তারা ভবনের বিভিন্ন তলায় যাতায়াত শুরু করে। এভাবে ভবনের ওপর থেকে নিচে নামার সময় কমান্ডোরা দুজনকে গুলি করে। এতে তারা পড়ে যায়। তাদের একজন শরীরে বেঁধে রাখা বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটায়।

এর আগে মর্জিনা নামে যে নারী জঙ্গির কথা বলা হয়েছিল, নিহত দুজনের মধ্যে সে আছে কি না জানতে চাইলে ফখরুল আহসান বলেন, প্রাথমিকভাবে দুজনকেই পুরুষ বলে মনে হচ্ছে। তবে ভেতরে আরও এক বা একাধিক জঙ্গি থাকতে পারে। সেখানে নারী জঙ্গিও থাকতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল বলেন, জঙ্গিরা ‘ওয়েল ইক্যুইপড’। তাদের কাছে ছোট অস্ত্র, বোমা, উচ্চশক্তির বিস্ফোরক আছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যে গ্রেনেড মেরেছি, তারা সেই গ্রেনেড কুড়িয়ে আমাদের দিকেই ছুড়ে মেরেছে। টিয়ার গ্যাস মারলে আগুন জ্বালাচ্ছে। বোঝা যায়, এসব কৌশল প্রয়োগে তারা অভ্যস্ত। আর যেভাবে উচ্চশক্তির বিস্ফোরক ঘরে লাগিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা যথেষ্ট জ্ঞান রাখে যে কীভাবে পরিবেশকে অভিযানকারীদের কাছে দুর্গম করে তুলতে হয়। যে কারণে অভিযান শেষ করতে ঝুঁকি আছে, সময়ও লাগছে। তাদের শরীরে সুইসাইড ভেস্ট লাগানো আছে। তারা মাঝে মাঝে ফায়ার করছে।’

আতিয়া মহলের বাসিন্দাদের উদ্ধারের সময় পুরো ভবন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেই নিয়ন্ত্রণ কী করে জঙ্গিদের হাতে চলে গেল, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, পুরো ভবনের নিচ থেকে জায়গায় জায়গায় জঙ্গিরা উচ্চশক্তির বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছে। এ কারণে লোকজনকে উদ্ধারকাজ শুরু করা হয় ছাদ দিয়ে। পাশের ভবনের সঙ্গে মই লাগিয়ে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, আগে কমান্ডোরা পাঁচতলায় গিয়ে তা বিপদমুক্ত করে অবস্থান নেয়। তারপর লোকজন সরানো শুরু হয়। এভাবে দোতলা পর্যন্ত নেমে লোকজনকে সরানো হয়। নিচতলার লোকজনকে গ্রিল কেটে ও ছিদ্র করে সরানো হয়। বাসিন্দাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার পর জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটায়।

গত শনিবারের হামলাকারীদের সঙ্গে আতিয়া মহলের ভেতরে থাকা জঙ্গিদের যোগসূত্র আছে কি না এবং জঙ্গিদের সংগঠন, মতাদর্শ, পরিচয় ইত্যাদি জানতে চাইলে ফখরুল আহসান বলেন, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে না। পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে বলতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আতিয়া মহলে বোমা-বারুদের ফাঁদ থাকায় রাতে আর বাড়ির ভেতরে জঙ্গি আস্তানায় ঢোকার সম্ভাবনা নেই। তবে অভিযান চলমান আছে। পুরো এলাকা কড়া নিরাপত্তায় ঘিরে রাখা হয়েছে। আজ সোমবার সকালে নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হতে পারে।

গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সিলেটের এই জঙ্গি আস্তানায় জঙ্গিদের বড় কোনো নেতা থাকতে পারে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র বলছে, নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতা মঈনুল ওরফে মুসা এবং ঢাকার মিরপুরের রাফিদ হাসান আতিয়া মহলে আছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

রাফিদ ও তার খালাতো ভাই আয়াদ হাসান গত বছরের ৯ আগস্ট চিরকুট লিখে রেখে ঢাকার মিরপুরের বাসা থেকে একসঙ্গে বের হয়। এরপর থেকে তাদের আর খোঁজ পায়নি পরিবার।

এ ছাড়া মর্জিনা নামে যে নারীর কথা এসেছে, সে সীতাকুণ্ড জঙ্গি আস্তানা থেকে ধরা পড়া নারী জঙ্গি আরজিনার বোন হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

সর্বশেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৭, ০২:০০
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন