একসঙ্গে ১২ কবর খোঁড়া দেখেনি কেউ

সড়ক দুর্ঘটনায় বড়বলদিয়া গ্রামের নিহত ১২ জনের জানাজা ও দাফনে অংশ নেয় কয়েক হাজার মানুষ। বড়বলদিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ ময়দান থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তোলা।Prothom Alo
সড়ক দুর্ঘটনায় বড়বলদিয়া গ্রামের নিহত ১২ জনের জানাজা ও দাফনে অংশ নেয় কয়েক হাজার মানুষ। বড়বলদিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ ময়দান থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তোলা।
বড়বলদিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, তাঁর জীবদ্দশায় কখনো এক মাসে এত লাশ এবং এক দিনে এত কবর খুঁড়তে দেখেননি।

কবরস্থানে ১২ জনের জন্য সারি ধরে কবর খোঁড়া হয়েছে ১২টি। বড়বলদিয়া গ্রামের মানুষ একসঙ্গে এত কবর খোঁড়া এর আগে কখনো দেখেনি। এমন ঘটবে কখনো ভাবতেও পারেনি তারা। একসঙ্গে ১২ জনের মৃত্যুতে গোটা গ্রাম মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের এ গ্রামে স্বজনহারাদের আহাজারি এখন। চলছে মাতম।

আজ রোববার সকালে চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর মহাসড়কে দামুড়হুদার জয়রামপুরে ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে ভটভটির যে ১৩ জন আরোহী নিহত হয়েছেন, এঁদের ১২ জনের বাড়িই বড়বলদিয়া গ্রামে।

নিহত ওই ১২ জন হলেন আব্দার হোসেন (৪৮), বিল্লাল হোসেন (৪০), আবু বকর সিদ্দিক (৪৩), ইজ্জত আলী (৬০), নজির আহমেদ (৩০), শান্ত আহমেদ (২২), হাফিজুর রহমান (৪০), বিল্লাল মণ্ডল (৩৫), রফিকুল ইসলাম (৩৫), জজ হোসেন (২৮), লাল মোহাম্মদ (৩৫) ও শাহীন হোসেন (৩৫)। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী সুলতানপুর গ্রামের শফিকুল ইসলামও (৩৫) একই দুর্ঘটনায় মারা যান। শফিকুলের জানাজা ও দাফন নিজ গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়।

বড়বলদিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম (৭৫) বলেন, তাঁর জীবদ্দশায় কখনো এক মাসে এত লাশ এবং এক দিনে এত কবর খুঁড়তে দেখেননি।

বড়বলদিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ ময়দানে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে নিহত ব্যক্তিদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দুই সারিতে ছয়জন করে ১২ জনের পাশাপাশি দাফন করা হয়। দাফনকালে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের আর্তনাদে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়।

আজ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামটিতে ঘুরে জানা গেছে, নিহত ব্যক্তিদের সবাই হতদরিদ্র পরিবারের প্রধান। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের সবাই নির্মাণশ্রমিক। প্রায় দুই মাস ধরে তাঁরা আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা ইউনিয়নের মুন্সিগঞ্জ-পারকৃষ্ণপুর পয়েন্টে নির্মাণাধীন সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। বিল্লাল হোসেন তাঁদের সরদার।

বিল্লাল হোসেনের একমাত্র ছেলে সোহান (১৪) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। মাত্র দুই বছর বয়সে সে মাকে হারিয়েছে। এবার বাবাকে হারিয়ে দিশেহারা। নিহত নজিরের দুই মেয়ে বিবাহিত। একমাত্র ছেলে আবদুর রহমান এবারে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আবদুর রহমান জানায়, ভিটের পাঁচ শতক জমি ছাড়া আর কিছুই নেই।

দুর্ঘটনায় নিহত জজ হোসেনের স্ত্রী আকিরন আট বছর বয়সী মাইমুনা ও চার বছরের ফাহাদকে নিয়ে অথই সাগরে। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে মা সাহেদা খাতুন পুরোই উন্মাদ হয়ে গেছেন। তিনি কখনো হাসছেন, কখনো কাঁদছেন, আবার কখনো ছেলের নাম ধরে গান করছেন।

ছয় বোনের একমাত্র ভাই হাফিজুর রহমান। আজ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তাঁর। প্রতিবেশীরা জানান, বোনদের কাছে হাফিজুর ছিলেন খুবই আদরের। তাঁর দুই ছেলে। ছেলে উজ্জ্বল পঞ্চম শ্রেণিতে এবং ছোট সিয়াম এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। এই দুই সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী আকিনা খাতুনের সামনে শুধুই অন্ধকার।
আবু বকরের দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে বিবাহিত। একমাত্র ছেলে শামসুল হক সুমন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। বাবার অকালমৃত্যুতে তার সামনে শুধুই অন্ধকার। শাহীন মাত্র দুই বছর হলো বিয়ে করেছেন। জীবন উপভোগ করার আগেই তাঁকেও পরপারে চলে যেতে হলো। বাকিদের একই দুর্দশা। এ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কত দিনে মুক্তি মিলবে, সেটাই দেখার বিষয়।

একই দুর্ঘটনায় আহত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আতিকুল ইসলাম (২৫) জানান, ভটভটিটি দুই মাস ধরেই শান্ত আহমেদ চালিয়ে আসছিলেন। রোববার জজ হোসেন শখ করে চালান। শখ পূরণ করতে গিয়েই সারা জীবনের আশা-ভরসা সব শেষ হয়ে গেল।

আজকের জানাজা ও দাফনকাজে দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল হাসান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজাদুল ইসলাম আজাদ, পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলমসহ এলাকা ও আশপাশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা পড়ান মুফতি আকতারুজ্জামান। চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম দুর্ঘটনায় হতাহত হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহযোগিতার জন্য এ সময় সবার প্রতি আহ্বান জানান।

জানাজার আগে ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খাজা আবুল হাসনাত ঘোষণা দেন, হতাহত প্রতিটি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপকোষাধ্যক্ষ মাহমুদ হাসান খানের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের হাতে শিগগিরই টাকা পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।

সর্বশেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৭, ২২:৪৪
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন