ঢাকা এয়ারপোর্টে গ্রামের মেয়ের হাতে ধরা পড়লো অজ্ঞান পার্টির সদস্য

অজ্ঞান পার্টির সদস্য চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের তাজুলের শার্টের কলার চেপে ধরেছে রুবিনা।
অজ্ঞান পার্টির সদস্য চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের তাজুলের শার্টের কলার চেপে ধরেছে রুবিনা।

পাঁচ বছরের ছেলে দশনি অসুস্থ। জরুরি অস্ত্রোপচার ছাড়া বাঁচবে না। মায়ের কি আর বিদেশ বিভুঁইয়ে মন টেকে? সৌদি আরব যাওয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় রুবিনা আক্তার এক মাসের বেতন নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। এসেই পড়লেন প্রতারকের খপ্পরে। তবে হাল ছাড়েননি। পাঁচ দিন পর প্রতারককে ধরে উদ্ধার করে ছেড়েছেন টাকা। সেই প্রতারক এখন কারাগারে।

ফেসবুকে ম্যাজিস্ট্রেটস অল এয়ারপোর্টস অব বাংলাদেশের পাতায় হার না-মানা রুবিনা আক্তারের সেই অভিযানের গল্প আছে। সহায়-সম্বলহীন রুবিনার আজ খোঁজ করছেন অনেকেই।

জয়পুরহাটের আমদই গ্রামের রুবিনা আক্তার মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সঙ্গে কথা বলেন।

রুবিনার ভাষ্যমতে, ১৬ মার্চ সকাল নয়টার দিকে তাঁকে বহনকারী বিমান ঢাকার মাটি ছোঁয়। তখন তাঁর কাছে ৮০০ রিয়াল। ঢাকায় নেমেই ৬০০ রিয়াল ভাঙিয়ে ফেলেন। ইচ্ছে ছিল জয়পুরহাটে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছে বাকি রিয়াল ভাঙাবেন। টাকাটা বাড়ি পৌঁছেই লাগার কথা। দশনির অস্ত্রোপচার করাতে হবে। দশনি আর বাড়ির লোকজনের জন্য তাড়াহুড়োর মধ্যেই কিছু কেনাকাটাও করেছেন। ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে বিমানবন্দরের ১ নম্বর ফটকের কাছে আসতেই তাঁর সঙ্গে তাজুল ইসলামের দেখা। কোনো ভূমিকা না করেই আন্তরিকভাবে তাজুল ইসলাম এগিয়ে এসে বললেন, ‘বইন, একমাত্র বইনটারে একটু আগে দুবাইতে পাঠায়া দিলাম। পরানডা ছিঁড়া যাইতেছে।’ রুবিনার মন কেঁদে উঠল। তিনিও গল্পগুজব করতে শুরু করলেন। বললেন, তিনি জয়পুরহাটের আমদই গ্রামে যাবেন। তাঁর একমাত্র ছেলে অসুস্থ। গল্পে গল্পে জানতে পারেন, তাজুলের বাড়ি দিনাজপুরের হিলি। দুজনে একসঙ্গে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে তাঁদের গন্তব্য গাবতলী। ফার্মগেটে এসে তাঁরা বাস বদলালেন। সকাল থেকে রুবিনার কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুর হয়ে এসেছে। রুবিনা তাঁর ‘পাতানো ভাই’ তাজুলের হাতে ১০০ টাকা দিয়ে পাউরুটি আর পানি কিনে আনতে বললেন। তাজুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তুমি সত্যিই আমার বোন হলে আজ এমন করে টাকা দিতে চাইতে না। আসলে পর কখনো আপন হয় না।’

রুবিনার ‘পাতানো ভাই’য়ের আনা পাউরুটি খেয়ে বোতল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তাজুল সঙ্গে সঙ্গে নিজের রুমাল বের করে সযত্নে পানি মুছে দিলেন। আর যায় কোথায়!

রুবিনা সে সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, ‘আমার মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না। আমি দেখতিছি, সে আমার সব কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু বলতে পারছি না। কী আর বলব। আমার বাচ্চার অপারেশনের টাকা।’

তবে বেশির ভাগ মানুষ যা করেন, রুবিনা তা করলেন না। তিনি ঢাকায় এক বান্ধবীর বাড়ি উঠলেন। প্রতিদিন সকালে বিমানবন্দরে যান, আবার ফিরে আসেন। পঞ্চম দিন সেই এক নম্বর ফটকের কাছে তাজুল ইসলামকে ঘুরঘুর করতে দেখা গেল। একটুও দেরি না করে রুবিনা শার্টের কলার চেপে ধরলেন তাজুলের। চিৎকারে ছুটে এল পুলিশ।

রুবিনা বললেন, ‘আমি পুলিশকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। পুলিশ তাজুলের কথাও শুনল। তাজুল বললেন, সে তাঁর ভাইকে তুলে দিতে এসেছে। পুলিশ তাঁর হাত থেকে ফোন নিয়ে তাজুলের স্ত্রীকে ফোন দেয়। তাঁর বউ বলে, তাজুলের বোন বিদেশ যাচ্ছে। কথায় গরমিল পেয়ে পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলে।’

বিষয়টি বিমানবন্দরে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নজরে আসে। তাঁরা তাজুলের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা উদ্ধারে সহযোগিতা করেন। কিন্তু হদিস পাওয়া যায়নি ২০০ রিয়াল আর ব্যাগ-বোঁচকাগুলোর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাজুল বেশ কিছুদিন ধরেই এই কাজ করে আসছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে। প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই তাঁর পেশা।

বিমানবন্দরে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইউসুফ বলেন, ‘কৃতিত্ব রুবিনার একার। আমরা শুধু ও যেন বিচার পায় সেই চেষ্টাটুকু করেছি। তাজুল এখন কারাগারে। তাঁর দুই বছরের জেল হয়েছে।’

রুবিনা বলেন, ‘আমার সৎ পয়সা। বাচ্চার অপারেশনের পয়সা। আমার আর কেউ নাই। টাকা ছাড়া বাচ্চার অপারেশন হবে না। খালি হাতে বাড়ি গিয়ে করব কী? আমার বিশ্বাস ছিল ব্যাটাকে ধরতে পারব।’

সর্বশেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৭, ০২:৫৩
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন