আকাশে হঠাৎ প্লেন দেখে যুবকটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ‘ওই দ্যাখ, আবার বিদ্যাশ যাওয়া হইতেছে, আমার ডেট আইবো না?’ যাকে দেখাতে এটা বলা, সে হাসতে হাসতে বন্ধুর পিঠে চাপড় দেয়। বলে, ‘এইবার তোর ডেট পড়বো, দেখিস।’ প্রথম যুবকটা কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নদীর বাতাসে উড়ে যায় মানুষের প্রশ্বাস।
গত বন্যায় যে জায়গাটায় ছিল পাড়ছোঁয়া পানি, এই বৈশাখে সেখানে সুনসান শান্ত নদী। খাড়া পাড় থেকে যে সেতুটা কিছুটা উঠে মুখ থুবড়ে পানিতে পড়েছে, সেই জায়গাটার নাম খাড়াকান্দি। বিকেলের আলোয় ভাঙা সেতুটায় চুপচাপ বসে ছিল দুই বন্ধু। দুজনই যুবক। পাশেই কয়েকটি শিশু পলিথিনে বানানো ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। ওদের মধ্যে যার নাম আবদুল্লাহ, তার ঘুড়িটা বারবার গোত্তা খেয়ে পড়ছিল। বন্ধুরা হাসাহাসি করে বলছিল, আবদুল্লাহ ঘুড়ি ওড়াতে পারে না।
আবদুল্লাহর বাবাও এখন ধলেশ্বরীতে মাছ ধরতে পারে না। গত বন্যায় দুই পারের লোকেরা প্রচুর মাছ পেয়েছিল। কিন্তু খেয়ানৌকার কাদের মাঝি বলেন, ‘চৈইত মাসের ১৬-১৭ তারিখে ঢাকা শহরের কেমিক্যালের পানি আইসা সব মাছ মাইরা ফালাইছে। প্রতিবছর চৈইত মাসে এমন হয়। নিচের দিকে কেরানীগঞ্জের শিল্পাঞ্চল, ওপরের দিকে হেমায়েতপুরের ট্যানারিপল্লি। কোথাকার বিষাক্ত পানি এসে মাছ মেরে ফেলল, কে বলবে? কিন্তু লকডাউনের মধ্যে ধলেশ্বরীর জেলেদের হয়েছে দ্বিগুণ জ্বালা। মাটিতে কাজ নাই, নদীতে মাছ নাই।
এর মধ্যে উড়োজাহাজটা দক্ষিণ থেকে এসে পূর্ব দিকে মোড় নিচ্ছে। ওই দিকেই রাজধানীর বিমানবন্দর। লকডাউনে দেশের ভেতর চলাচল বন্ধ থাকলেও বিদেশগামী, বিশেষত প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ করা বিমান চলাচল জারি আছে। আখতার নামের যুবকটির সেটাই আশা।
দালালদের কাছে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়েছিল। তারা তার জন্য সৌদি আরবে কাজের ভিসা তথা আকামা জোগাড় করে দেবে। সেখানে দুলাভাই আছে তার, বাকি ব্যবস্থা তিনিই করবেন। কিন্তু হঠাৎ লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ায় যাত্রা বন্ধ। আশা ধরে বসে আছে, যেকোনো সময় খবর আসবে।
কিন্তু তার বন্ধু সাব্বিরের কোনো আশা নেই। বাড়ি বিক্রি করে সরকারি চাকরির জন্য ঘুষ দিয়েছিল এক জায়গায়। দুই বছর ঘোরানোর পর চাকরি না হলেও টাকা অবশ্য ফেরত এসেছে। এখন রোজার বিকেলে, লকডাউনের মধ্যে তারা হেঁটে এসে বসেছে নদীর পারে।
ততক্ষণে সেতুর বাঁ দিকের খেয়াঘাটে ইঞ্জিনচালিত নৌকা এসে ভিড়েছে। এপারের খাড়াকান্দি থেকে ওপারের হোগলাগাতি চলে নৌকাটি। দুটি তরুণ অনেকক্ষণ ধরে নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। তারা এসেছে মাওয়া ঘাট থেকে।
তাদের পরনে মেকানিক্যাল শ্রমিকের পোশাক, মাথায় হেলমেট, পিঠে ব্যাগ। এখানেও একজনের কাজ আছে, আরেকজন বেকার। সোহাগ নামের ছেলেটি করে বিদ্যুতের লাইনের উঁচু উঁচু টাওয়ার তৈরির কাজ। হাত তুলে দেখাল নদীর দুই পাড়ে অনেকগুলো টাওয়ার তৈরি হচ্ছে। উন্নয়ন একেবারে চোখের সামনে।
চোখের সামনে সেই নৌকায় বসে ছিলেন আরও চারজন। একজনের হাতের পলিথিনে কিছু ছোলা-মুড়ি ইত্যাদি। মধ্যবয়সী লোকটা কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন ঢাকায়। টাকা জমিয়ে হোগলাগাতিতে একখণ্ড জমি কিনে সংসার পেতেছিলেন। তিন দিন পর আজ একটা কাজ পেলেন, সেটা দিয়েই চাল-ডাল আর ইফতারির ছোলা-মুড়ি কিনে এই সন্ধ্যায় বাড়ি যাচ্ছেন।
পাশের প্রৌঢ় লোকটির মুখে কথা নাই। রোজা রাখায়, নাকি হতাশায় মুখ চুপসে আছে, কোনো কথাই বললেন না। নৌকার মাঝি শুধু বললেন, ‘গরিবের কে আছে?।
নৌকা ছেড়ে দিল। ওপারে পৌঁছানোর পর দুদিকে খেত। গত বন্যায় অনেকের বাড়িঘর-ফসল ডুবে গিয়েছিল। এবারে দেখলাম, শাকের আঁটি জড়ো করা হচ্ছে ঘাটে। লাউ-সবজিও আছে। সব যাবে ঢাকার রায়েরবাজারের আড়তে।
একটি শিশু গরুর লেজ ধরে ধরে বাড়ি ফিরছে। খোলা মাঠে ফুটবল খেলছে একদল কিশোর। ঘাসের ওপর বসে তিনজন কিশোরী পরস্পরের মাথার উকুন খুঁটছে। খাড়াকান্দির বটতলার বাজার থেকে ইফতারের খাবার কিছু কেনা হয়েছিল। মনে হলো, আজ কোনো কৃষকের বাড়িতে একসঙ্গে বসে ইফতার করি। ইটবিছানো সড়ক থেকে জমির আইল ধরে কিছু দূর গেলে লাগোয়া কয়েকটা বাড়ি। গত বর্ষায় এ বাড়ির এক নারীকে দেখেছিলাম টিনের ডোঙা নৌকায় করে ভাসছেন। আর এই যে এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ির পৈঠায়।
ইতস্তত করে কিষানি মানুষটি হাসিমুখে আমাদের ঘরের মধ্যে বসাতে গেলেন। দুই পাশে দুটি শোয়ার ঘর, একটা টিনের, আরেকটা বেড়ার। কিন্তু সবচেয়ে মজবুত টিনের ঘরটিতে মানুষ থাকে না। একদিকে ৮ থেকে ১০ বস্তা রসুন জমা করা।
বাড়ির পেছন দিকে কলতলা, তার পাশে লেবুর গাছ, কলার গাছ। তার পাশে গোয়ালে তিনটি স্বাস্থ্যবান গরু। আঙিনায় বসে ইফতার সাজানো হচ্ছে, বাড়ির ছোট মেয়েটি লেবু এনে দিল মায়ের হাতে। বড় ছেলেটিও খেলার মাঠ থেকে চলে এসেছে। নদীর ওপারের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সুন্দর এক পরিবার। ঠিক ইফতারে সময় পরিবারের কর্তাপুরুষটি এলেন। আমাদের দেখে কোনো কথা বললেন না, হাসলেনও না। সোজা চলে গেলেন গোয়ালঘরে। নিজে খাবার আগে গরুগুলোকে খাবার দিলেন।
পুরুষটির গম্ভীর মুখের কারণ এতক্ষণে বোঝা গেল। বাড়িতে কোনো ইফতারই করা হয়নি। পুরুষটি অসুস্থ বলে রোজা রাখেন না। তাঁর স্ত্রী, যাঁর নাম মঞ্জিরা, তিনিই রোজা। বললেন, ‘একাই রোজা তো, কিছু করি নাই। একটু পানি মুখে দিয়া নামাজ পইড়া সে ভাত খামু।’
আজ রান্না করেছেন নদী থেকে ধরা গুলশা মাছের ঝোল। সেটাই সবার রাতের খাবার। সেই খাবার না হয় হবে, তার আগে চাঁদের আলোয় খোলা উঠানে একটি কৃষক পরিবারের মেহমান হওয়ার সুখ উপভোগ করা গেল। পাওয়া গেল আরও কিছু জীবন।
ইফতার শেষে ফিরছি নদীর ঘাটের দিকে। কৃষক মানুষটির নাম জজ মিয়া। নিজের এক চিলতে জমিতে এবার বেগুন করেছেন। প্রচুর বিষ-সার দিতে হয়। তার ওপর বৃষ্টি না হওয়ায় বেগুন বাড়ছে না। গরু তিনটি পুষছেন কোরবানির হাটে বেচার আশায়। রাতে গরুর ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ঘরে থাকেন। তিনটি গরুর জন্য তিনটি ফ্যান, নিজের চৌকির ওপর একটি।
পুরো পরিবার আমাদের ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিল। আকাশে চাঁদ আরও উজ্জ্বল হয়েছে। দূর থেকে মেয়েলি কণ্ঠের গান ভেসে আসছে। নৌকায় নদী পার হতে হতে জজ মিয়ার ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী ছেলেটির কথা মনে ভাসছে।
বলছিলাম, স্কুল তো বন্ধ, সারা দিন তো খালি খেলতেছ। তার উত্তর, ‘খেলতেই ভালো লাগে। যতক্ষণ খেলি, ততক্ষণ আর খিদা লাগে না।’
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
পাঠকের মন্তব্য