পাটশ্রমিকদের দক্ষতা আজ মূল্যহীন

  • খুলনা
  • ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:৪৬
  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • ৪২৫৩ বার পঠিত
  • মন্তব্য

দেশের ২৫টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জুট মিলের মধ্যে ৯টির অবস্থান খুলনা অঞ্চলে। পাট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সম্প্রতি সব কটি জুট মিল বন্ধ ঘোষণার পর শ্রমিকদের দেনা-পাওনা চুকিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এতে খুলনাঞ্চলে বেকার হয়েছেন অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক। পাশাপাশি ১৫ হাজার দক্ষ শ্রমিকের অভিজ্ঞতায় পেরেক ঠোকা হয়েছে।

বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জুট মিলগুলোর বিভিন্ন বিভাগে বহু বছর ধরে কাজ করার মধ্য দিয়ে বিশেষভাবে দক্ষতা অর্জনকারী শ্রমিকরা এখন কর্মহীন। সাধারণ থেকে দক্ষ শ্রমিকের তকমা পেতে অন্তত ১০ বছর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এ ছাড়া একজন দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে মিল কর্তৃপক্ষেরও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। মিল বন্ধ হওয়ায় এসব শ্রমিকের দক্ষতার আর কোনো মূল্য থাকল না।

মধ্যবয়সী শ্রমিক জালাল গাজী ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন প্লাটিনাম জুট মিলের বেসিন বিভাগে। প্রথমে বদলি শ্রমিক হিসেবে তিনি এ বিভাগে হেলপার পদে কাজে যোগ দেন। পরে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে পদোন্নতি পান। মিল বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিলের একজন দক্ষ শ্রমিক। তার মতো অনেককেই বিভিন্ন বিভাগে বহু বছর ধরে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে। জালাল গাজীর প্রশ্ন, ‘কে দেবে এই অভিজ্ঞতার মূল্য? আর কবেই বা পাব মিলের কাছ থেকে পাওনা সাত লাখ টাকা বকেয়া?’

একই বিভাগের স্প্রিং বিভাগের শ্রমিক মিরাজ আকন। ২০ বছর ধরে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। এর আগে আরও ১০ বছর কাজ করেছেন বদলি শ্রমিক হিসেবে। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মিরাজ একজন দক্ষ শ্রমিক হয়েও মিল বন্ধ হওয়ায় বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তিনি বলেন, মিল বন্ধ হওয়ার পর তার মতো কয়েক হাজার শ্রমিকের জীবনে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নেমে এসেছে। জুট মিলে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এখন তা আর কাজে লাগছে না, দক্ষতার মূল্যও কেউ দিচ্ছে না। তার মতে, কয়েক হাজার দক্ষ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়লে নতুন করে জুট মিলগুলো চালানো সম্ভব হবে না। তিনি অবিলম্বে মিলের কাছে পাওনা ১২ লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ ও মিল চালুর দাবি জানান।

শুধু মিরাজ আকন বা জালাল গাজীই নন, তাদের মতো ১৫ থেকে ২০ হাজার দক্ষ শ্রমিক রয়েছেন প্লাটিনাম, পিপলস, দৌলতপুর, স্টারসহ এই অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জুট মিলে। এসব শ্রমিকের কারও কারও ২০ থেকে ৩০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে মিলের বেসিন, স্প্রিং, ব্রেকার, টিপারিং, জুটসহ বিভিন্ন বিভাগে। আর ৯টি মিলে স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এর মধ্যে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প সহায়ক পরিবেশ থাকায় এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা জুট মিলগুলো খুলনার শিল্পাঞ্চল খালিশপুর, আটরা গিলেতলা এবং যশোর এলাকার মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর মধ্য দিয়ে দেশের জাতীয় অর্থনীতির চাকাও সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তারা বলছেন, ১৯৫৬ সালের দিকে গড়ে ওঠা এসব জুট মিল একসময় বেশ লাভজনক ছিল। তবে কালের প্রবাহে নানা প্রতিকূলতার কারণে বারবার মিলগুলো বন্ধ হয়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে কখনো কখনো। শ্রমিকদের কর্মদক্ষতায় লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখও দেখেছে বারবার। তারপরও গত জুলাই মাসে জুট মিলগুলোতে শেষ হুইসেল বাজানো হলো। এর ফলে পাটকেন্দ্রিক অর্থনীতি ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি পাটশিল্পের সোনালি ঐতিহ্য হারাল আর অভিজ্ঞ শ্রমিকরা বেকার হলো।

জানা গেছে, খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিলগুলোতে দুর্দিন নেমে আসা শুরু হয় গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও পাট ক্রয় খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না করাসহ নানা কারণে লোকসানের মুখে পড়ে এসব মিল। শুরু হয় শ্রমিক ছাঁটাই। আবার কখনো বন্ধ করা হয় কয়েকটি মিল। সেই সময় জুট মিলগুলোতে চলা এমন পরিস্থিতির প্রতিবাদে তীব্র শ্রমিক আন্দোলনে অশান্ত হয়ে ওঠে খালিশপুরসহ গোটা খুলনার শিল্পাঞ্চল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে কিছুটা সুদিন ফিরলেও শেষরক্ষা হয়নি। মিলগুলো বন্ধ হওয়ায় কয়েক হাজার দক্ষ শ্রমিক এখন বেকার। কীভাবে ফিরে আসবে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ- এমন প্রশ্ন এখন শ্রমিকদের মুখে মুখে।

শ্রমিকনেতা কেরামত আলী দুলাল জানান, প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক বিভিন্ন জুট মিলে কাজ করতেন। মিল বন্ধ করে দেওয়ার পর অধিকাংশ শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বকেয়া পাওনা এখনো পরিশোধ করেনি কর্তৃপক্ষ। কবে পাওয়া যাবে, তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। বারবার সময় নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, তবে শুধু আশ্বাস মিলছে, টাকা মিলছে না। তার মতে, মিল বন্ধ হওয়ায় অল্পসংখ্যক শ্রমিক কিছুটা সুবিধা পেলেও সংকটে রয়েছে ৯০ ভাগেরও বেশি শ্রমিক।

পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের সদস্যসচিব এস এ রশিদ মনে করেন, প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিককে বেকার করা হয়েছে। পাওনা টাকা না পেয়ে চরম কষ্টে দিন কাটছে তাদের। সরকারের উচিত মিলগুলো বন্ধ না করে পুনরায় চালু করা।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের নেতা শেখ আশরাফুজ্জামান বলেন, মিল বন্ধ না করে দক্ষ শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে বেশি লাভবান হওয়া যেত। শ্রমিক নয়, মিল পরিচালনা পরিষদের ব্যক্তিদের দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্যই জুট মিলগুলো ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

বিজেএমসির খুলনা অঞ্চলের জিএম গোলাম রব্বানী জানান, শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করার প্রক্রিয়া চলছে। তাদের মোট পাওনার অর্ধেক নগদ এবং বাকিটা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। পরবর্তী সময়ে পিপিপির মাধ্যমে মিলগুলো চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। তার মতে, এই অঞ্চলের ৯টি জুট মিলের স্থায়ী-অস্থায়ী প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিকের কয়েক শ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। তিনি জানান, জুট মিলগুলো বন্ধ করার সময় সরকারি ঘোষণা ছিল পিপিপির (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মাধ্যমে পরবর্তীতে চালানো হবে। কবে নাগাদ পুনরায় মিল চালু হবে, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলেননি। তবে খুব শিগগির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।

এদিকে বন্ধ জুট মিলের দক্ষ শ্রমিকদের কী হবে- এমন প্রশ্ন বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে। জবাবে বিভিন্ন সময় স্থানীয় সরকারদলীয় রাজনীতিক, বিজেএমসির কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে শ্রমিকদের। বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, আধুনিকায়নের পর মিল চালু হলে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত দক্ষ শ্রমিকরাই অগ্রাধিকার পাবেন। তাদের মূল্যায়ন করা হবে।

এ বিষয়ে খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জুট মিলগুলো চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জুট মিলগুলো চালু করা হলে বিভিন্ন মিলের দক্ষ শ্রমিকরাই অগ্রাধিকার পাবেন।’

আর খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, ‘শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত আন্তরিক। জুট মিলগুলো লাভজনক করার লক্ষ্যে পিপিপির মাধ্যমে চালু করা হবে। সক্ষম শ্রমিকরাই মিল চালুর পর অগ্রাধিকার পাবেন।

উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সারা দেশের ২৫টি পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর খুলনা অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জুট মিল বন্ধ হয়ে যায়।

সর্বশেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:৪৮
নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন