‘মুক্তি বাঁচতে চিৎকার করছিল, কেউ আগায়া যায় নাই’

‘ শয়তানরা মুক্তির গায়ে আগুন ধরায়া দিল। আমার মেয়ে বাঁচতে চিৎকার করছিল। কিন্তু কেউ আগায়া যায় নাই। শয়তানরা ধরা না পড়লি মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে না।’

প্রতিপক্ষের দেওয়া আগুনে দগ্ধ কলেজ ছাত্রী মুক্তির মৃত্যুর পর তার মা সাংবাদিকদের কাছে এভাবেই ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন। মুক্তির মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা-বাবাসহ স্বজনরা।

গত ১৯ আগস্ট আগুনে দগ্ধ হওয়ার পর মুক্তি সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সোমবার মধ্যরাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।

মুক্তি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নাগডেমরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হকের মেয়ে। তিনি পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।

মঙ্গলবার দুপুরে নাগডেমরা গ্রামে মুক্তির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মৃত্যুর খবর বাড়িতে পৌঁছার পর থেকে বাবা-মা আর স্বজনদের মাঝে চলছে আহাজারি। তাদের সান্ত্বনা দিতে পারছেন না প্রতিবেশিরা। আর কি বলেই বা সান্ত্বনা দেবেন তারা। এ মৃত্যু তো মেনে নেওয়ার নয়।

মুক্তির বাবা মোজাম্মেল হক নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। বলেন, আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। যারা পুড়ায়া মারছে তারা যেন কঠিন শাস্তি পায়। মা নাজমা খাতুন বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বলেন, ‘ওই সময় শয়তানরা মুক্তির গায়ে আগুন ধরায়া দিল। সে বাঁচতে চিৎকার করছিল। কিন্তু কেউ আগায়া যায় নাই। শয়তানরা ধরা না পড়লি মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে না।’

এলাকাবাসী ও নাগডেমরা ইউপি চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, ছালাম গংরা খুবই সন্ত্রাসী প্রকৃতির। মাঝেমধ্যেই মানুষকে হয়রানী ও মারধর করে। এর আগেও এরকম ঘটনা কয়েকবার ঘটিয়েছে। এই ঘটনার পরও তারা মুক্তির পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। আমরা তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা এবং মুক্তিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে তাদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

থানায় দায়েরকৃত মামলার বরাত দিয়ে সহকারি পুলিশ সুপার (বেড়া সার্কেল) মিয়া আশিস বিন হাসান জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্যানাল দখলকে কেন্দ্র করে নাগডেমরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক গংদের সঙ্গে একই গ্রামের আব্দুস ছালাম গংদের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এরই জের ধরে গত ৩১ জুলাই দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষসহ ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে সাঁথিয়া থানায় পাল্টপাল্টি দু’টি মামলা হয়। এ মামলায় উভয় পক্ষই জামিনে বের হয়ে আসে।

জামিনে বের হওয়ার পর প্রতিশোধ পরায়ন ছালাম গং তার লোকজন নিয়ে গত ১৯ আগস্ট সকাল দশটায় মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় মোজাম্মেলের মেয়ে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী মুক্তি খাতুন বাধা দিতে গেলে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় ছালাম গং।

এতে মুক্তির বুক থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে যায়। মুক্তিকে প্রথমে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসক। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে ৮ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে সোমবার মধ্যরাতে মৃত্যুর কাছে হার মানেন মুক্তি।

পাবনার পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম, সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহাঙ্গীর আলম, এএসপি (সার্কেল বেড়া) মিয়া আশিস বিন হাসান ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে দুই বান্ডিল টেউটিন ও নগদ ছয় হাজার টাকার আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস জানান, এ ঘটনায় মোজাম্মেল হক বাদি হয়ে ছালামসহ ৩২ জনকে আসামী করে ১৯ আগস্ট সাঁথিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার পর পুলিশ বিভিন্ন সময়ে অভিযান এখন পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশ বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে সচেষ্ট আছে। আমরা আদালতের অনুমতি নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসককে দিয়ে মৃত্যুর আগে মুক্তির জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছি। জবানবন্দিতে সে বলে গেছে কারা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী।

এদিকে, নিরাপত্তার স্বার্থে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

সর্বশেষ আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০১৮, ১৯:৫৯
অনলাইন ডেস্ক

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন