মাদকাসক্ত প্রেমিকের খপ্পরে বিপর্যস্ত তরুণী

লম্বা, ফর্সা, সুদর্শন যুবক। ভদ্র-নম্র ব্যবহার। কিন্তু হঠাৎ করেই বদলে যেতে থাকে সে। প্রেমিক সাইদুর রহমান অনন্তের এই বদলে যাওয়ার চরম শিকার হোন রাইসা নামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে মারধর করা হতো রাইসাকে। একদম রক্তারক্তির ঘটনা। সেই দিনগুলো স্মরণ হলে এখনো চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে তার। এখানেই শেষ হয়নি। শেষ পর্যন্ত এই প্রেমের চরম পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে তরুণীকে। তার ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য পুরুষ তাকে কল দিচ্ছে। ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ফোনে তাকে শারীরিক প্রস্তাব দিচ্ছেন অনেকে। ফেসবুকে ছবি সংবলিত বিজ্ঞাপন। ‘আমি টাকার বিনিময়ে ইমু, হোয়ার্টসঅ্যাপ, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, স্কাইপিতে রিয়েল… করি। কন্ট্রাক্টে গিয়ে কাজ করি। আমি আর সবার মতোন আগে টাকা দাবি করি না, কাজ করে টাকা নেই।’ শুধু এরকম স্ট্যাটাস না। আছে আরো আপত্তিকর বাক্য। সঙ্গে অর্ধ উলঙ্গ, উলঙ্গ ছবি। ছবি দেখে এবং ফোন নম্বর পেয়ে অসংখ্য মানুষ বারবার কল দিচ্ছিলেন তরুণীর ফোন নম্বরে। কেউ কেউ সরাসরি আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন নিজের বাসায়, আবাসিক হোটেলে। থমকে যান তরুণী। কিছুই বলতে পারছিলেন না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। বাধ্য হয়ে ফোন বন্ধ করে দেন। বিড়ম্বনার এখানেই শেষ না। বাসা থেকে বের হতে পারছিলেন না। লোকজন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পরিচিত জনরা জিজ্ঞাসা করে, বিষয়টা কি? ফোনে কেউ কেউ বলেন, কি হয়েছে তোর- সমস্যা কি? কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিষয়টি জেনে যান তার পরিবারের সদস্যরাও। দু’চোখে অন্ধকার দেখছিলেন তরুণী। বেঁচে থাকাটাই তার কাছে কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। তারপরই আইনের আশ্রয় নেন। মামলা করেন ঢাকা মেট্রোপলিটনের হাজারীবাগ থানায়। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিটিটিসি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গ্রেপ্তার করা হয় হাজারীবাগের নিমতলা রায়ের বাজারের সুলতানগঞ্জ রোডের নাছির উদ্দিন মিন্টুর ছেলে সাইদুর রহমান অনন্তকে। গ্রেপ্তারের পর অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছে সে। এমনকি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আদালতেও। জানা গেছে, একই এলাকায় বসবাসের কারণে পরিচয় ছিল আগে থেকেই। ২০০৮ সালের জুন মাসে ওই তরুণী ও অনন্তের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রেমের সম্পর্ক চলছিলো ঠিকঠাক। চুটিয়ে প্রেম করছিলেন এই জুটি। ঘুরে বেরিয়েছেন বিভিন্নস্থানে। এরমধ্যেই ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন অনন্তের মধ্যে।
ক্লাসমেট কেউ ফেসবুকে তাকে মন্তব্য করেছে। কোথাও তার হাসির প্রশংসা করে কেউ কিছু লিখেছে রাইসাকে। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় অনন্ত। অনন্ত লেখাপড়া ছেড়েছে মাধ্যমিকের পরেই। সে চায় না রাইসা লেখাপড়া করুক। ভার্সিটিতে ক্লাস করুক। ওখানে গেলেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় রাইসার। কথা হয়, আড্ডা হয়। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে। রাইসা বলেন, ২০১৬ সালে রায়েরবাজারের সুলতানগঞ্জ রোডে বাসার পাশেই এসব বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয় দুজনের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রবল জোরে একটা ঘুষি মারে রাইসার মুখে। ঘুষিটি চোখের নিচে পড়ে থেঁতলে যায়। রক্ত ঝরতে থাকে। এরমধ্যেই নিজের মাথা দিয়ে দেয়ালে আঘাত করতে থাকে অনন্ত। রক্তাক্ত দুজনেই। তারপর চিকিৎসা নেয় স্থানীয় হাসপাতালে। এখানেই শেষ না। প্রায়ই রাইসার কাছে টাকা খোঁজা শুরু করে অনন্ত। রাইসা জানান, দু’শ, পাঁচ শ’ করে টাকা চাইতো। নিজে টিউশনি করে আয় করা টাকাগুলো প্রেমিকের হাতে তুলে দিতেন তিনি। এতকিছুর পরও স্বপ্ন দেখতেন ঘর বাঁধার। একটি সুখি সংসারের। কিন্তু ধারণা করছিলেন তার প্রেমিক বিপথগামী হয়ে গেছে। আশেপাশের লোকজন তাই বলছিলো অনন্ত ফেনসিডিল সেবন করে। প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি রাইসা। কিন্তু তার অল্পতে রেগে যাওয়া, কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা, প্রায়ই টাকা দাবি করার কারণে বিশ্বাস করেন অনন্ত মাদকাসক্ত হয়ে গেছে। পুরান ঢাকার ওই এলাকায় তখন মাদকের ভয়াবহ ছড়াছড়ি। সরাসরি অনন্তের কাছে জানতে চান। অনন্ত স্বীকার করে সে মাদকাসক্ত। কিচ্ছু করার নেই। মেনে নিতে হবে। রাইসা দাবি করেন, বিষয়টি অনন্তের মাও জানতেন। কিন্তু তারা তাকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করাবেন দূরে থাক। তারা মনে করেন এই বয়সে একটু আধটু এরকম হয়। বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরমধ্যেই তরুণী জানতে পারেন, শুধু সে না, আরো কয়েক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আছে তার। যা পৌঁছেছে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত। তরুণী সম্পর্কের ইতি টানতে চান। অনন্ত সম্পর্ক ধরে রাখতে চায়। এ নিয়ে তরুণীকে বেদম মারধরও করে অনন্ত। কিন্তু সামাজিক বিষয় চিন্তা করে এসব বিষয় কাউকে না জানিয়ে নীরবে হজম করতে থাকেন। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী সিদ্ধান্তে অনড়। তারপরই ভিন্নপথ বেছে নেয় অনন্ত। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় তরুণীর নানা অ্যাঙ্গেলের ছবি। এমনকি ছবি এডিট করে উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ ছবিও প্রকাশ করা হয় এসব ওয়েবসাইটে। তরুণীর ফেসবুক আইডি হ্যাক করে এতে ছড়িয়ে দেয়া হয় নোংরা ছবি। তরুণীকে একজন যৌনকর্মী হিসেবে উপস্থাপন করা হয় ফেসবুকে। নানা স্ট্যাটাসের মধ্যে একটিতে লেখা হয়েছে ‘ভিডিও সেক্সের ক্ষেত্রে বিকাশ করুন। আমার ফোনে বিকাশ করা আছে। বিকাশ করার পরেই ইমু নম্বর দেব। সরাসরি… ক্ষেত্রে আগে টাকা দিতে হবে না।’ গত ১৯শে জুলাই ওই তরুণীর ফেসবুক আইডি হ্যাক করে এভাবেই নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিলো মাদকাসক্ত প্রেমিক অনন্ত। এক দুই করে অনেকেই জেনে যাচ্ছিলো। নানা প্রশ্ন উঠছিলো। বাধ্য হয়েই পুলিশের সহযোগিতা নেন। ২৩শে জুলাই তাকে আটক করে সিটিটিসি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিট। পরদিন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় হাজারীবাগ থানায় মামলা করেন ওই তরুণী।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারের পর দুইদিনের রিমান্ডে নিয়ে অনন্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে তার অপরাধ স্বীকার করে ২৯ শে জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে বলে জানান তিনি। গ্রেপ্তার সাইদুর রহমান অনন্ত (৩২), হাজারীবাগ থানার নিমতলা রায়েরবাজারের সুলতানগঞ্জ রোডের ২১৮/১ খালেক মঞ্জিলের বাসিন্দা। তার পিতার নাম নাছির উদ্দিন মিন্টু।

সর্বশেষ আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০১৮, ০৯:৪১
অনলাইন ডেস্ক

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন