অংকন বিশ্বাস অর্ক:
বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত একটি থানা মেহেন্দিগঞ্জ। তারই এক করুন দৃষ্টান্তে অধিকারী মোহম্মদ দুলাল। পিতার ছয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান তিনিই। তার পিতা ছিলেন সেখানকার এক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। এরই মধ্যে যখন এদেশের বুকে নেমে এসেছিলো ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা, ঠিক তার বছর খানেক পরেই পিতা মারা যান। আর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব রেখে যান মোহম্মদ দুলালের মামার কাছে। কিন্তু সেখান থেকেই নেমে এলো জীবনে এক কঠিন ছাপ।
কথায় কথায় জানা গেলো, বন্যার দু এক বছর পরেও তারা এমন দিন কাটিয়েছে যখন কচুশাক সিদ্ধ, রুটি, একবেলা খেয়ে দিন পার করা। অথচ তার মামা কখনোই একটু সঙ্গ দেননি তাদের ছয় ভাইয়ের উপর। তখন ছোট পাঁচ ভাই একমাত্র ভরসা করে থাকতো বড় ভাইয়ের উপর। মোহম্মদ দুলালও বেশি ভালোবাসতেন বড় ভাইকে। কিন্তু সেই ভালোবাসা স্থায়ী আর হলোনা। বাবার মৃত্যুর পরে একপর্যায়ে তার বড় ভাইও সেই অভাব অনটনের মাঝে পাঁচ ভাইকে রেখে বিদায় হলেন পৃথীবি থেকে। ঠিক সেখান থেকেই পড়ালেখায় আর যুক্ত হতে পারেননি তিনি। তবুও ভেঙ্গে পড়েননি মোহম্মদ দুলাল। চল্লিশ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসেন নিজের বাঁচার তাগিদে। তিনি বললেন, খুব কম টাকা দিয়েই তখনকার সময়ে লঞ্চে করে ঢাকা আসা যেতো। প্রথমাবস্থায় ঢাকায় এসে একটা ফাষ্টফুডের দোকানে দশটাকার মাইনে হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন। ক্রমে ক্রমে নিজের সাবলম্বী হওয়াটাকে ধরে রেখে ২০০০ সালে বিয়ে করেন। বর্তমানে একপুত্র সন্তানের জনক। ছেলেকে পড়াশুনা করানোর জন্য নিজের স্ত্রীকেও যুক্ত করান গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে।
তবে আঘাত যার ছাড়েনা, তার হয়তো অতি সহজেই আঘাত ছাড়েনা। এখনো যুক্ত আছেন সেই ফাষ্টফুডের দোকানে। চলতি বছরে এসে তার বেতন হয়ে দাড়িয়েছে দশ টাকা থেকে দশহাজার টাকায়। সারা রাত তৈরী করেন রোল, পিজ্জা, ছমুসা ছাড়াও বাহারী রকমের খাবার। তার কাজগুলো রাতেই করতে হয়। আর দিনে বেলা ৩ টা থেকে সন্ধ্যে ৭ টা পর্যন্ত থাকে ওয়েট মেশিন নিয়ে। কখনো ধানমন্ডি ৩২, অথবা সংসদ ভবন। কিন্তু এত্ত অল্প আয়ে কি এই ব্যাস্ত শহরে পরিবার নিয়ে থাকা সম্ভব?
তিনি জানালেন, প্রতিমাসে ছেলের পড়াশুনার জন্য ব্যয় হয় পাঁচ হাজার টাকা। বাসাভাড়া, থাকা খাওয়া বাবদ অতি কষ্টেই কাটে। তবে তার থেকে বেশি বেদনাদায়ক হলো যখন কোনো বিত্তশালীরা ওয়েট মেশিন ব্যবহার করে টাকা না দিয়েই চলে যায়। নিজের বসতভিটে ছেড়ে দেয়ার মতোই। তারা ভালো করে লেখাপড়া না জানায় তার মামাও সুযোগ করে নিচ্ছে। তাই বাড়ীর প্রতি টানও তেমন হারিয়ে ফেলার পথে। হারিয়ে ফেলছে সেসব ভিটে মাটির চাওয়া। চাওয়াটা কেবল এই অল্প বেতনে নিজের সন্তানে মুখে হাসি এবং একজন মানুষের মতো মানুষ হিসেবে দেখা। আর মোহম্মদ দুলালের একমাত্র লক্ষ্য এখন এটাই।
পাঠকের মন্তব্য