জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় উপাচার্য বলেন, ‘ভাষা সংগ্রামী একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি মর্মাহত। তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন জ্ঞানী ও বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী ব্যক্তিকে হারালো। এই ক্ষতি পূরণ হবার নয়। শিক্ষক, গবেষক, সাহিত্যিক এবং লেখক হিসেবে তাঁর অবদান জাতি কখনোই ভুলবে না। বাঙলা সাহিত্য তাঁর মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি যে অবদান রেখেছেন, জাতি তা চিরকাল স্মরণ করবে।’ উপাচার্য অধ্যাপক মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
অধ্যাপক মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের মরদেহ আগামীকাল শুক্রবার এগারোটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকলের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য রাখা হবে। বাদ জুমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজে জানাযা এবং বাদ আছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসবভন সংলগ্ন খেলার মাঠে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বাংলাদেশী লেখক, গবেষক, ভাষাসৈনিক ও বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক। বাংলাদেশ শিল্পকলা একডেমির প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সাহিত্য ও শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি একুশে পদকও লাভ করেছেন। ২০১১ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ‘সুন্দরম’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ১৯২৭ সালের ১ মে বগুড়ার মহাস্থানগড় সংলগ্ন চিঙ্গাশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সা’দত আলি আখন্দ, তিনি স্বনামখ্যাত লেখক ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। তিনি ছিলেন মা-বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান।
নূরউল ইসলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় থেকে স্নাতকোত্তর ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শৈশব থেকেই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ, ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ ও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ তাঁর চিন্তা ও কর্মে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। তাঁর কর্মজীবন বিচিত্র, বর্ণাঢ্য। সাংবাদিকতা করেছেন। দৈনিক সংবাদ-এর প্রথম সংখ্যা থেকে যুক্ত ছিলেন সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কাজ করেছেন মিল্লাত-এ। শিক্ষকতা করেছেন সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে (খণ্ডকালীন)। ১৯৫১ সালে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। ১৯৫৩-৫৪ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত হন তিনি।
প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, অনুবাদ, সম্পাদনা মিলিয়ে মুস্তাফা নূরুউল ইসলামের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় অর্ধশত। সম্পাদনায় যুক্ত থেকেছেন পূর্বমেঘ, অগত্যা, সুন্দরম নামের তিনটি বিখ্যাত পত্রিকার। ১৯৫০-এর দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় আলাউদ্দিন আল আজাদের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদিত দাঙ্গার পাঁচটি গল্প তাঁর একটি সাড়া জাগানো প্রকাশনা। অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনাতেও বিশেষ মাত্রা যোগ করেছেন তিনি। দেশ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য নিয়ে বিচিত্র বিষয়ে তিনি দীর্ঘকাল ধরে মুক্তধারা, কথামালা, বাঙালির বাংলা নামে অনুষ্ঠান করেছেন।
২০১৮ সালের ৯ মে রাত সাড়ে ৯ টার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিজ বাসভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।