নিয়াজির নৃশংসতার প্রথম শিকার বাঙালি মেজর

মেজর আবু ইউসুফ মুশতাক আহমেদ।
মেজর আবু ইউসুফ মুশতাক আহমেদ।
ঢাকা সেনানিবাসে ইস্টার্ন কমান্ডের অপারেশন কক্ষে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে নিয়াজি উর্দুতে বলেন, এই হারামজাদা জাতির মনে রাখা উচিত, তিনি কে। একপর্যায়ে তিনি বাঙালি জাতির চেহারা বদলে দেওয়ার কথা বলেন। এই ইঙ্গিত ছিল অশালীন। বৈঠকে অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এঁদের একজন মেজর আবু ইউসুফ মুশতাক আহমেদ। তিনি নিয়াজির এই কদর্য কথা সহ্য করতে না পেরে জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, এ ধরনের কথাবার্তা বলা খুবই আপত্তিকর এবং তাঁকে তা প্রত্যাহার করতে হবে। কক্ষে তখন পিনপতন নীরবতা। কোনো কথার জবাব না দিয়ে নিয়াজি ক্ষুব্ধ মেজাজে বেরিয়ে গেলেন।

২৫ মার্চের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে সামরিক অভিযান নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এমন একজন সেনা কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে, যিনি টিক্কা খানের চেয়েও দক্ষতার সঙ্গে গণহত্যা চালাতে পারবেন।

২ এপ্রিল সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ দশম পাকিস্তান পদাতিক বিভাগের সদর দপ্তরে মেজর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজিকে তলব করেন। ৩ এপ্রিল নিয়াজি সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করলে তাঁকে জানানো হয়, পূর্ব পাকিস্তানে যেভাবে অভিযান চলছে, তাতে ইয়াহিয়া খান পুরো সন্তুষ্ট নন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বয়সে কনিষ্ঠ হলেও অতীতের রেকর্ড দেখে তাঁকেই (নিয়াজি) ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হবে। এ ব্যাপারে নিয়াজির কাছে মতামত চাওয়া হলে তিনি গদগদ কণ্ঠে বলেন, প্রত্যেক সৈনিকেরই দায়িত্ব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করা। এরপর নিয়াজিকে লে. জেনারেল পদে উন্নীত করে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এসব তথ্য উঠে এসেছে একাত্তরের শুরুতে ঢাকায় দায়িত্ব পালনকারী আরেক সেনা কর্মকর্তা খাদিম হুসেন রাজার আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি: ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-১৯৭১ বইতে (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি পাবলিশার্স)।

রাজার ভাষ্যমতে, ৪ এপ্রিল নিয়াজি ঢাকায় এলেন। টিক্কা খান মনঃক্ষুণ্ন হলেও ১০ এপ্রিল নিয়াজির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।

১০ এপ্রিল বিকেল চারটা। নিয়াজি ঢাকা সেনানিবাসে ইস্টার্ন কমান্ডের অপারেশন কক্ষে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। তাঁকে কোমরে পিস্তল নিয়ে কক্ষে ঢুকতে দেখে সবাই হতবাক হন। এ ধরনের বৈঠকে অস্ত্র বাইরে রেখে আসার নিয়ম। নিয়াজি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ভবিষ্যতে কর্মকর্তারা ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় যেকোনো স্থানে পিস্তল নিয়ে যেতে পারবেন।

এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি উর্দুতে বলেন, এই হারামজাদা জাতির মনে রাখা উচিত, তিনি কে। একপর্যায়ে তিনি বাঙালি জাতির চেহারা বদলে দেওয়ার কথা বলেন। এই ইঙ্গিত ছিল অশালীন।

বৈঠকে অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এঁদের একজন মেজর আবু ইউসুফ মুশতাক আহমেদ। তিনি নিয়াজির এই কদর্য কথা সহ্য করতে না পেরে জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, এ ধরনের কথাবার্তা বলা খুবই আপত্তিকর এবং তাঁকে তা প্রত্যাহার করতে হবে। কক্ষে তখন পিনপতন নীরবতা। কোনো কথার জবাব না দিয়ে নিয়াজি ক্ষুব্ধ মেজাজে বেরিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর ধীরস্থির ও অবিচল মেজর মুশতাকও বেরিয়ে যান। এ ঘটনার পর পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তারা তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে ফিসফাস করছিলেন। পরদিন অফিসার মেসে মেজর মুশতাককে তাঁর কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

এ নিয়ে দুটি ভাষ্য আছে। খাদিম হুসেন রাজা তাঁর বইতে বলেছেন, মেজর মুশতাক বাঙালিদের সম্পর্কে নিয়াজির অপমানকর বক্তব্য সহ্য করতে না পেরে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা-গবেষক লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির লিখেছেন, মুশতাক রাতে মেসে ঘুমাতে গেলে নিয়াজি জওয়ান পাঠিয়ে তাঁকে হত্যা করিয়েছেন। এভাবেই তিনি বাঙালি কর্মকর্তার ‘ঔদ্ধত্যের’ জবাব দিয়েছেন (ইন কোয়েস্ট অফ ফ্রিডম: দ্য ওয়ার অব ১৯৭১, সম্পাদক মেজর জেনারেল আয়ান কারডোজো)।

কাজী সাজ্জাদ আরও লিখেছেন, ঢাকায় বাড়ি থাকা সত্ত্বেও এই বাঙালি মেজর অফিসার মেসে থাকতেন। সকালে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা একটি ট্রাকে সাদা কাফনে ঢেকে মুশতাকের লাশ তাঁর বাড়িতে আনেন এবং তাঁরা পরিবারকে জানান, তিনি বাথরুমে আত্মহত্যা করেছেন। পরিবারের সদস্যরা লাশ দাফন করতে চাইলে জানানো হয়, অনুমতি নেই। শুধু দেখানোর জন্য এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। পরে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

মুশতাকের পরিবারের দাবি, বাঙালি অফিসার হিসেবে মুশতাকের অস্ত্র বহনের কোনো সুযোগ ছিল না। তাহলে তিনি কীভাবে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবেন? তিনি যে মেসে ছিলেন, তাতে ১৩ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের কর্মকর্তারা ছিলেন। ধারণা করা হয়, ওই দিন খুব ভোরে কতিপয় সেনাসদস্য মুশতাকের কক্ষে গিয়ে গলা কেটে তাঁকে হত্যা করেন।

নিয়াজির এই আচরণে বিস্মিত হয়েছেন পাকিস্তানি কর্মকর্তা খাদিম হুসেন রাজাও। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রাজা যখন তাঁকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাচ্ছিলেন এবং করণীয় সম্পর্কে বলছিলেন, তখন নিয়াজি ঠাট্টা করে বলেন, ‘ওসব পরে দেখা যাবে। আপনি বরং আপনার বাঙালি বান্ধবীদের টেলিফোন নম্বরগুলো দিয়ে যান।’

মেজর মুশতাক ছিলেন অন্যতম জ্যেষ্ঠ বাঙালি কর্মকর্তা। তিনি ছিলেন মেধাবী ও সাহসী। যদি তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকে, সেটি করা হয়েছে নিয়াজির নির্দেশেই। সে ক্ষেত্রে, মেজর মুশতাকই ছিলেন নিয়াজির নৃশংসতার প্রথম শিকার।

সর্বশেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৮, ২৩:৪৫
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন