দীর্ঘদিন যাবত মোটর নিউরন ডিজিজের সাথে লড়াই করে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত এবং সুপরিচিত একজন বিজ্ঞানীতে পরিণত হওয়া স্টিফেন হকিং ৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন।
তিনি ছিলেন রসবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ, বিজ্ঞানের একজন জনপ্রিয় দূত এবং তিনি সব সময় নিশ্চিত করতেন যেন তাঁর কাজ সাধারণ মানুষেরা সহজে বুঝতে পারেন।
তাঁর লেখা বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ অনেকটা ধারণার বাইরে বেস্ট সেলার বা সবচেয়ে বিক্রিত বইয়ে পরিণত হয়।
যদিও এটা পরিষ্কার না ঠিক কতজন পাঠক এই বইয়ের শেষ পর্যন্ত যেতে পেরেছেন।
জীবদ্দশায় তিনি বেশ কিছু টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন এবং তার কৃত্রিম কণ্ঠস্বরে কথা বলেছেন।
স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ১৯৪২ সালে ৮ই জানুয়ারি অক্সফোর্ডে জন্ম নেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন জীববিজ্ঞানের গবেষক এবং তিনি স্টিফেন হকিং-এর মাকে নিয়ে জার্মানের বোমার আঘাত থেকে বাঁচার জন্য লন্ডনে পালিয়ে আসেন।
হকিং লন্ডন এবং সেন্ট অ্যালবানস এ বেড়ে ওঠেন। তিনি অক্সফোর্ডে পদার্থবিদ্যার ওপর প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রী অর্জন করে ক্যামব্রিজে কসমোলজির উপর স্নাতকোত্তর গবেষণা করেন।
কেমব্রিজে গবেষণা করার সময় তাঁর মোটর নিউরন রোগ ধরা পরে যেটা তাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অচল করে দেয়।
১৯৬৪ সালে যখন তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী জেন কে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন চিকিৎসকরা বলে দেন তিনি বড় জোর দুই থেকে তিন বছর বাঁচবেন।
কিন্তু রোগটি যতটা দ্রুততার সাথে ছড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছিল তার চেয়ে কম গতিতে ছড়ায় তার শরীরে। ১৯৮৮ সালে তিনি তার বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ প্রকাশ করেন।
বইটির প্রায় এক কোটি কপি বিক্রি হয়- যদিও লেখক জানতেন যে বইটির পরিচিতি হয়েছে “পঠিত হয়নি এমন সর্বাধিক বিক্রিত বই” হিসেবে।
তাদের তিন সন্তান আছে। ১৯৮৮ সালের মধ্যে হকিং এর অবস্থা এমন হল যে শুধুমাত্র কৃত্রিম উপায়ে কথা বলতে পারতেন তিনি।
তারকাখ্যাতি
স্টিফেন হকিং দেখান যে কৃষ্ণগহ্বর কিভাবে শক্তিক্ষয় করতে করতে শূন্যে মিলিয়ে যায়, পরবর্তীতে যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিতি পায়। কঠিন গাণিতিক হিসেব এবং পরীক্ষা ছাড়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় তুলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতার কারণে তিনি বিশেষভাবে পরিচিতি পান।
তবে তার “থিওরি অফ এভরিথিং” বা “সবকিছুর তত্ত্ব” মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে- যাতে তিনি ধারণা দেন যে মহাবিশ্ব কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই বিবর্তিত হয়।
“এই মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হলো- এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এসব নিয়ম”, তিনি বলেন “কবে এর শেষ হবে? কীভাবে শেষ হবে? এসবের উত্তর যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আমরা আসলেই ঈশ্বরের মন বুঝতে পারবো”।
বিখ্যাত মার্কিন কার্টুন সিম্পসনেও তার তারকা খ্যাতির চিহ্ন দেখা যায়- সিম্পসনের একটি পর্বে দেখানো হয় যে তিনি একটি পানশালায় কার্টুনটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হোমারের সাথে মদ্যপান করছেন এবং মহাবিশ্ব ডোনাট আকৃতির, হোমারের এমন একটি ধারণা চুরি করার চেষ্টা করছেন।
এছাড়াও তাকে বিবিসির জনপ্রিয় কমেডি সিরিজ রেড ডোয়ার্ফ, মার্কিন সিরিজ স্টার ট্রেক: নেক্সট জেনারেশন এবং বিগ ব্যাং থিওরির কয়েকটি পর্বে দেখা যায়।
তার ভঙ্গুর শারীরিক অবস্থা সত্ত্বেও তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লুকেসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে তার কাজ চালিয়ে যান এবং ২০০১ সালে তার দ্বিতীয় বই- ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল প্রকাশিত হয়।
খেয়ালী
তিনি বিশ্বাস করতেন যে তার অসুস্থতা তার জন্য কিছু উপকারও এনে দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, অসুস্থ হবার আগে তিনি জীবন নিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
অবশ্য তার শারীরিক অবস্থা অবধারিতভাবেই তাকে অন্যদের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। তিনি প্রায়সময়ই তার প্রথম প্রথম স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা বলতেন, যিনি ২০ বছরেরও বেশি তার দেখাশোনা করেছেন। যদিও তিনি যখন তার একজন নার্সের জন্য প্রথম স্ত্রীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন তখন তার বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনরা বেশ অবাক হয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে তিনি তার সাবেক নার্সকে বিয়ে করেন।
২০০০ সাল নাগাদ আঘাতের কারণে তিনি বেশ কয়েকবার কেমব্রিজের একটি হাসপাতালে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নেন। ঐসময় একটি অভিযোগ আসে যে তিনি কয়েক বছর যাবত নানাভাবে মৌখিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করে।
তবে তিনি ছিলেন বেশ খেয়ালী। তার হুইলচেয়ারটিই তিনি প্রায়সময় বেপড়োয়াভাবে চালাতেন এবং হকিং বারবার বলেন যে, তার এসব আঘাত কোন নির্যাতনের কারণে হয়নি। পরে বিষয়টি নিয়ে পুলিশও আর আগায়নি।
২০০৭ সালে তিনি প্রথম চলৎশক্তি হীন ব্যক্তি হিসেবে একটি বিশেষ বিমানে ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নেন। মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দেয়ার জন্যই তিনি এটি করেছেন বলে জানান।
“আমার বিশ্বাস পারমাণবিক যুদ্ধ, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি ভাইরাস অথবা অন্য কোন কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অবসান হতে পারে। মানুষ যদি মহাকাশে না যায় তাহলে আমার মনে হয় মানবজাতির কোন ভবিষ্যৎ নেই। যেকারণে আমি মানুষকে মহাকাশে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাই”।
২০১৪ সালে স্টিফেন হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয় ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ চলচ্চিত্র। জেন হকিংয়ের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় চলচ্চিত্রটি।
ডিসকভারি চ্যানেলের সাথে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, পৃথিবীর বাইরে কোন বুদ্ধিমান জীবনের উপস্থিতি আছে এমন ধারণা করাটা সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসীরা প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে পৃথিবীতে অভিযান চালাতে পারে।
পাঠকের মন্তব্য