নুজহাত তাবাসসুম: ক্লান্ত পিতা দিনশেষে কয়েকটি রুটি জোগাড় করে এনেছে ক্ষুধার্ত সন্তানদের মুখে তুলে দেবার জন্য। সৃষ্টিকর্তার কাছে সুক্রিয়া আদায় শেষে বাবা যখন তার সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবে, ঠিক তখনি কিছু দূরে শুনতে পেল বিস্ফোরণের শব্দ, তার সাথে ভেঙ্গে পরা কংক্রিটের শব্দ। তার ঠিক কিছু মুহূর্ত পর আশেপাশে সব স্তব্ধ হয়ে গেল বাবা হাতরে খুজছে তার সন্তানদের, কিন্তু খুজে পাচ্ছে না।
এটি কোন সিনেমার দৃশ্যাবলী নয়। এটি সিরিয়ার প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের ঘটনা। সিরিয়ায় প্রায় ৭ বছর ধরে চলছে ভয়ংকর এক গৃহযুদ্ধ যার ফলে এই পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ লোক নিহত হয়েছে , আহত হয়েছে আরও পাঁচ লাখ। এছাড়াও প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ বাস্তহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছে রিফিউজি ক্যাম্পে। সিরিয়ার এই যুদ্ধ বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধ। ২০১১ সালে শুরু হয় এই যুদ্ধ। ২০১১ সালের মার্চ মাসে আরব বসন্তে অনুপ্রানিত হয়ে সেদেশের বিরোধী দল সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক দেয়। বাসার আল আসাদ এর নেতৃত্বে বাথ পার্টির ৪০ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিরোধী দলের সাথে সাধারন জনগণ ও রাস্তায় নেমে আসে। সেই বিক্ষোভ মিছিলে সরকার ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করে যার ফলে নিহত হয় অনেক বিক্ষভকারী এবং এই আন্দোলন পুরো দেশব্যাপি ছড়িয়ে পরে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ২০১১ সালে জুলাই নাগাদ মাত্র তিন মাসে আসাদ বাহিনীর হাতে প্রায় ১৬০০০ বিক্ষোভকারী নিহত হয়। সিরিয়া সরকারের বিরোধীরা প্রথমে অগোছালো থাকলেও পরবর্তীতে সৌদি , টার্কি এবং যুক্তরাষ্ট্র এর সমর্থনে নিজেদের সেনাবাহিনী গড়ে তোলে যার নাম ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। আসাদ সরকারের অনেক সৈন্য পরবর্তীতে নিজ দল ত্যাগ করে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি তে যোগদান করে। প্রথমে শুধু হালকা অস্ত্র বা মর্টার দিয়ে আক্রমন করলেও পরবর্তীতে তুরস্কের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ট্যাংক কিংবা হেলিকপ্টার সহযোগে হামলা চালাতে শুরু করে। বিদ্রোহীদের সাথে উগ্র ইসলামপন্থীর আল কায়েদা গোষ্টীর কিছু অনুসারীরাও আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।
আসাদ বাহিনীকে আবার সহযোগিতা করছে রাশিয়া, হিজবুল্লাহ এবং ইরান। রাশিয়ান বিমান হামলার সহায়তায় সিরিয়ায় আসাদ বাহিনী তাদের অবস্থানকে মজবুত করছে।
আসাদ বাহিনী ও ফ্রি সিরিয়ান আর্মিদের পাল্টা সংঘর্ষের ফলে প্রান হারাচ্ছে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। এই গৃহযুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষগুলো তাদের মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র,বাসস্থান,শিক্ষা ও চিকিৎসা এর কোনটাই পাচ্ছে না বরং প্রতিটি মুহূর্ত নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসেবে বিদ্রোহী অঞ্চল গুলোতে লাখ লাখ মানুষ ভুগছে তীব্র খাদ্য ও পানির সংকটে। জাতিসংঘ একজনের জন্য যে ত্রান দিচ্ছে তা তিন থেকে চারজনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। ৩০ লক্ষেরও বেশি শরণার্থী মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের নানা দেশে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নারী শিশু বৃদ্ধ সকলেই প্রাণভয়ে পালাচ্ছে।
সিরিয়ান মুসলিমদের জন্য এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি মৃত স্বজনদের জানাযা পড়া যেন প্রথা হয়ে গেছে। পুরো দেশ যেন এক ভয়ংকর মৃত্যুকুপে পরিনত হয়েছে। এই সমস্যার কোন সঠিক সমাধান হবে কিনা জানি না। তবে লাখ লাখ মানুষের প্রান নিয়ে যে খেলা চলছে তা নিয়ে পুরো বিশ্বের তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমাদের মাথা ব্যাথা শুধু জাতির নতুন ক্রাশ কিংবা কোন সেলিব্রেটিদের তালাক কিংবা মৃত্যুর খবর নিয়ে। অন্যদিকে লাখ লাখ নিরীহ শিশুর প্রান গেল! যাক! তাতে আমাদের কি?
পাঠকের মন্তব্য