সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় বা পরবর্তীকালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যারা ভারত ছেড়ে তখনকার পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন ভারতে থেকে যাওয়া তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীদেরও তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে আর কোনও অধিকার থাকবে না।
ভারতের পার্লামেন্ট মঙ্গলবার সে দেশের ‘শত্রু সম্পত্তি আইনে’ যে সংশোধনী পাস করেছে, তার সুবাদে সরকার এখন থেকে সেই সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার পাবে।
এই সংশোধনী নিয়ে বিতর্কের সময় পার্লামেন্টে একাধিক বিরোধী দল অভিযোগ করেছিল এটি একটি মুসলিম-বিরোধী পদক্ষেপ, কিন্তু সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে।
ষাটের দশকে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ লড়ার পর ভারত ১৯৬৮তে শত্রু সম্পত্তি আইন পাস করেছিল - যাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হল ৪৯ বছর বাদে।
এই সংশোধনী অনুসারে, যারা তখন ভারত ছেড়ে পাকিস্তান বা চীনে চলে গিয়েছিলেন তারা মারা যাওয়ার পরও ভারতে থেকে যাওয়া তাদের ওয়ারিশরা তাদের সম্পত্তি আর কখনওই ফিরে পাবেন না - শত্রু সম্পত্তি হিসেবে সরকার তা জব্দ করতে পারবে।
এই আইন প্রযোজ্য হবে তখনকার পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান, যা অধুনা বাংলাদেশ এবং চীনে পাড়ি দেওয়া ব্যক্তিদের সবার জন্যই।
পার্লামেন্টে বিলটি পাস করানোর সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং দাবি করেন, এই বিলটিকে জাতি বা ধর্মের দৃষ্টিকোণে দেখা কখনওই উচিত হবে না। কারণ শুধু পাকিস্তানে চলে যাওয়া লোকেরাই নন, অনেক চীনা নাগরিক ও তাদের সম্পত্তিও এর আওতায় এসেছে।
তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে, যাদেরকে আমরা শত্রু বলে গণ্য করেছি তাদের মৃত্যুর পর তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তির রং বদলে যেতে পারে না, তখনও সেটা শত্রু সম্পত্তিই থাকে।”
তবে পার্লামেন্টে বামপন্থী দল আরএসপি-র এনকে প্রেমাচন্দ্রন দাবি করেন, এই পদক্ষেপ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।
কংগ্রেস নেতা শশী থারুর আরও স্পষ্ট করে বলেন, এই বিল ভারতের মুসলিমদেরই বেশি ক্ষতি করবে।
মি. থারুরের কথায়, “সোজা কথা সোজা বলাই ভাল - এই বিল ভারতের লক্ষ লক্ষ নাগরিকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে, আর তারা সবাই মুসলিম। চীনাদের সম্পত্তির পরিমাণ এখানে খুবই কম। পাকিস্তানে যে শুধু একটি সম্প্রদায়ের লোকই গিয়েছিলেন তা আমরা সবাই জানি। ফলে এখন এই পদক্ষেপ আমার মতে প্রায় অসাংবিধানিকই শুধু নয় - স্বাভাবিক ন্যায়েরও পরিপন্থী।”
সরকার অবশ্য এই যুক্তি মানছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা পাকিস্তানের নেয়া পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছেন মাত্র এবং তা কীভাবে স্বাভাবিক ন্যায়ের বিরোধী সেটাই তার মাথায় ঢুকছে না।
রাজনাথ সিংয়ের পাল্টা যুক্তি: “পাকিস্তান তো আমাদের ভারতীয় নাগরিকদের সম্পত্তি জব্দ করে রেখেছে। তা তো তারা ওয়ারিশদের কখনও ফিরিয়ে দেয়নি। ফলে আমার মতে ন্যায় সেটাই হবে যখন আমরাও তাদের সম্পত্তি তাদের উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দেব না।”
এই বিলে সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মেহমুদাবাদের রাজার উত্তরাধিকারী আমির মোহামেদ খান, যিনি উত্তরপ্রদেশে প্রায় ৯০০ সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ছেন।
অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর ও তার ছেলেমেয়েরাও এই আইনের জেরে কিছু সম্পত্তি খোয়াতে পারেন, কারণ শর্মিলার প্রয়াত স্বামী মনসুর আলি খান পতৌদির এক আত্মীয় বেশ কয়েক দশক আগে পাকিস্তানে গিয়ে বসত করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস পার্লামেন্টে বিলটিকে সমর্থন করে, আর তাদের তরফে সভায় বলেন সাংসদ সৌগত রায়।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “বিলটি আমরা সমর্থন করেছি কারণ আগের তুলনায় সেটি ভাল হয়েছে। এখন হাইকোর্টে আবেদন করারও সুযোগ রাখা হয়েছে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে এর তেমন প্রভাব হবে না, কারণ কলকাতাসহ রাজ্যে এই জাতীয় যত বিতর্কিত সম্পত্তি ছিল, সেই সব বিবাদ অনেক আগেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আমাদের রাজ্যে এটা কোনও বড় জ্বলন্ত সমস্যা নয়।”
তৃণমূল এমপি-র দাবি সত্যি হলে ধরে নেওয়া যায়, এখনকার পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা সে আমলের পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি দিয়েছিলেন তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে সে রাজ্যে তেমন আর কোনও বিরোধ নেই।
তাদের উত্তরাধিকারীরা হয় ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেছেন কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে মামলাও তুলে নিয়েছেন।
পাঠকের মন্তব্য