ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা চরমে পৌঁছেছে বলে উদ্বেগ জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন দেশের কয়েক ডজন সাবেক আমলা।
পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক মহম্মদ আফরাজুলকে রাজস্থানে পুড়িয়ে মেরে ফেলা, গোরক্ষকদের তাণ্ডবে পহেলু খান বা উমের খানদের মৃত্যু, কিংবা হরিয়ানায় কিশোর জুনেইদ খানকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা - এই জাতীয় বহু ঘটনার উল্লেখ করে তারা সরকারের কাছে এর প্রতিকার দাবি করেছেন।
আর এই চিঠিতে সই করেছেন এমন ৬৭ জন, যারা সবাই কর্মজীবনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
কিন্তু কেন এই সাবেক আমলারা এমন একটি চিঠি লেখার মতো বিরল পদক্ষেপ নিলেন?
নরেন্দ্র মোদি সরকারের উদ্দেশে লেখা এই খোলা চিঠিতে যারা সই করেছেন তারা প্রত্যেকেই ভারতের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ, পুলিশ ও ফরেন সার্ভিসের প্রাক্তন কর্মকর্তা।
সাবেক আমলা, কূটনীতিক বা পুলিশ অফিসাররা অবসরের পর একজোট হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, এমনটা ভারতে খুব একটা দেখা যায় না।
কিন্তু এই উদ্যোগের অন্যতম প্রধান কারিগর ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্য সচিব অর্ধেন্দু সেন বলছিলেন সরকারের নীরবতাই তাদের বাধ্য করেছে এই ধরনের চিঠি লিখতে।
মি সেন জানাচ্ছেন, প্রথমে তারা আট-দশজন মিলে গত জুন মাসে সরকারকে এই বিষয়ে একটি চিঠি লেখেন।
পরে দেখা যায়, প্রতিরক্ষা বাহিনীরও শ’খানেকেরও বেশি সাবেক কর্মকর্তা একই ধরনের একটি চিঠি প্রস্তুত করেছেন। তখন থেকেই দুই গোষ্ঠী হাত মিলিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচী নিচ্ছেন।
”আসলে গত দুচার বছরে যে সব কাণ্ডকারখানা চলছে তাতে আর চুপ থাকা যাচ্ছে না। আমরা আমাদের কাজ করছি - যদিও সরকারের কাছ থেকে কোনও সাড়া পাইনি। তবে বহু লোক আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন, সমর্থন করছেন”, বলছিলেন মি সেন।
ভারতে মুসলিম-খ্রিষ্টানদের মতো সংখ্যালঘুরা যেভাবে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছেন, সেটাই যে এই চিঠিতে সই করতে তাকে প্রণোদিত করছে, স্পষ্টভাবেই তা বলছিলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক পুলিশ-প্রধান মীরন বোরওয়ানকার।
“ইদানীং আমি অনুভব করছি সংবিধান যে সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলে এ দেশে তা মানা হচ্ছে না। সংখ্যালঘু সমাজ যে অস্বস্তিতে আছে সেটা তো দেখাই যাচ্ছে, তাদের ওপর হামলা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সাহায্য করছে না,” মিঃ বোরওয়ানকার বলেন।
”আমি এমন একটা দেশ দেখতে চাই, যেখানে সব ধর্ম, সব জাতির সমান অধিকার নিশ্চিত হবে - কিন্তু সেটা আজকাল আর হচ্ছে না বলেই আমাদের এখানে সই করতে হল।”
ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আগেও ঘটেছে, কিন্তু এখন যেভাবে দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নীরব থাকছেন, সেটাই আসলে সবচেয়ে উদ্বেগের - বলছিলেন অর্ধেন্দু সেন।
তার কথায়, “এখন মানুষে-মানুষে যেভাবে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, এ জিনিস আমরা ভারতে আগে কখনও দেখিনি। একের পর এক উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে।
”তবে ঘটনাগুলো যত না, আমরা তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন ওই সব ঘটনায় সরকারের প্রতিক্রিয়ায়। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এই সব ঘটনায় হয় নীরব থাকছেন, নয়তো দায়সারা জবাব দিচ্ছেন”, মিঃ সেন কলেন।
সাবেক কূটনীতিক এবং বাংলাদেশ ও নেপালে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জিও এই চিঠিতে সই করেছেন।
সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিপদ নিয়ে বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরও অবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই, এটাই তার গভীর আক্ষেপ।
“পরিস্থিতির কোনও উন্নতিই নেই। আর যেভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরি করা হচ্ছে, তার পরিণতি যে দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে ভাবলে শিউড়ে উঠতে হয়”, মিঃ মুখার্জি বলেন।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কোনও বিশেষ ঘটনা তাকে বেশি করে নাড়া দিয়েছে?
দেব মুখার্জি বলেন, “সবগুলো ঘটনাই তো শকিং, এগুলো থেকে তো বাছবিছার করা যায় না। তবু বলব গত জুনে যেভাবে জুনেইদ ছেলেটাকে মারা হল … ভাবুন, ঈদের বাজার করে ফিরছে একটা বাচ্চা ছেলে, তাকে যেভাবে …”
”কিছুতেই মানতে পারি না, মানতে পারি না…” বলতে বলতে ধরে আসে মিঃ মুখার্জির গলা।
”আসলে যে-দেশে ষোলো বছরের এক সংখ্যালঘু কিশোরকে ছুরি মেরে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করা হয়, তারপর আর কারোরই চুপ থাকা সাজে না”, তিনি কলেন।
কিন্তু রাষ্ট্র যে এই সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের আবেগ বা উদ্বেগের দাম দিতে প্রস্তুত, এখনও পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে তেমন কোনও আভাস নেই।
পাঠকের মন্তব্য