বাংলাদেশের মানুষের জন্য শ্রীলঙ্কার ভাষা বোঝা যতটা কঠিন, লঙ্কানদের জন্যও বাংলা ভাষা সে রকমই দুর্বোধ্য ব্যাপার হওয়ার কথা। এই সিরিজে দুই দলই বোঝে এ রকম ভাষা একটাই আছে, অদৃশ্য অক্ষরে যেটি লেখা থাকে উইকেটের পিঠে। তবে সেই উইকেট যখন বানান একজন শ্রীলঙ্কান কিউরেটর, ভাষাটি কি শ্রীলঙ্কার জন্যই বেশি বোধগম্য হয়ে যায়!
এই সংশয়ের সঙ্গে আরও কিছু সন্দেহ মিলে ইতিমধ্যেই বিসিবি ব্যাখ্যা চেয়েছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার কাছে। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালের উইকেটটি কেন বাংলাদেশ দলের চাহিদা অনুযায়ী হলো না? তবে আজ থেকে শুরু প্রথম টেস্টটি যে মাঠে হবে, সেই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট কোনো শ্রীলঙ্কান বানাননি। বানিয়েছেন বাংলাদেশের কিউরেটর জাহিদ রেজা। এবার তাই ব্যাখ্যা চাওয়ার পালা শ্রীলঙ্কার।
কাল দুপুরে স্টেডিয়ামে এসে অধিনায়ক দিনেশ চান্ডিমালকে নিয়ে মাঝমাঠে চলে এলেন শ্রীলঙ্কার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। প্রায় তৈরি একটি উইকেট দুজনে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। হাতের চাপে, আঙুলের টোকায় যেন বুঝে নিতে চাইলেন উইকেটের চরিত্র। কিন্তু তখন কি আর তারা জানতেন, এই উইকেট সেই উইকেট নয়!
শ্রীলঙ্কার কোচ, অধিনায়ক অনুশীলনের আগে যে উইকেটটি দেখেছেন, প্রথম টেস্ট সেটিতে হচ্ছে না। হবে সেটির পাশের এক উইকেট বাদ দিয়ে আরেকটি উইকেটে। সেটি তখনো চটের নিচে ঢাকা ছিল। আর উইকেট পরিচর্যার জিনিসপত্র রাখা ছিল খোলা উইকেটটার পাশে। চান্ডিমাল-হাথুরুরা তাই ধরে নিয়েছিলেন, এটিই টেস্টের উইকেট। যদিও কিউরেটরের পক্ষ থেকে নাকি জানানো হয়েছিল, উইকেটের কাজ তখনো শেষ হয়নি। কাজেই বলা যাচ্ছে না, কোনটিতে খেলা হবে।
অনুশীলন শেষে শ্রীলঙ্কা দল জানল, টেস্ট হবে চটের নিচে লুকিয়ে থাকা উইকেটে। কোচ, অধিনায়কের সঙ্গে এবার আরও ছয়-সাতজন মিলে এলেন উইকেট দেখতে। মাঠকর্মীরা এক পাশের চট সরিয়ে দিলেন। ওই উইকেট দেখে শ্রীলঙ্কানদের মনে নানা সংশয়। আশপাশের কোনো উইকেটে এর মধ্যে পানি দেওয়া হয়নি তো! স্টাম্প গাঁথার গর্তগুলো ভেজা মনে হচ্ছে! ততক্ষণে উইকেটের পাশে চলে এসেছেন কিউরেটর। তিনি এসে চান্ডিমালসহ কয়েকজনকে ওখান থেকে সরিয়েই দিলেন। কারণ রীতিনীতি না মেনে স্পাইক লাগানো বুট পরেই তাঁরা হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছিলেন উইকেটের ওপর।
উইকেট বাদ দিলেও এই টেস্ট নিয়ে আলোচনা হওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। হঠাৎ পাওয়া চোট সাকিব আল হাসানকে ছিটকে দেওয়ায় নেতৃত্ব চলে এসেছে সহ-অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কাঁধে। অধিনায়ক হিসেবে কেমন করবেন তিনি? ১৬ জনের স্কোয়াডে ছয় স্পিনারের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, স্বাগতিক বাংলাদেশ স্পিন উইকেটেই খেলতে চায়। কিন্তু শ্রীলঙ্কাও কি স্পিনে কম বলীয়ান! দলে সুযোগ পেলে চার বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নেমে রাজ্জাক কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন? চমক হয়ে আসা ১৭ বছর বয়সী অফ স্পিনার নাঈম হাসানের হাতেই বা কি জাদু আছে! রাজ্জাক তো এই টেস্টে খেলবেন বলেই শোনা যাচ্ছে। নাঈমেরও কি অভিষেক হবে? বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা দুই দলের সর্বশেষ টেস্টটি হয়েছে গত বছরের মার্চে কলম্বোয়। নিজেদের শততম সেই টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ। ত্রিদেশীয় সিরিজের হতাশা ঢেকে আত্মবিশ্বাস জাগানিয়া স্মৃতিটাই কি বড় হয়ে উঠবে সিরিজে?
বাংলাদেশ বনাম হাথুরুসিংহের লড়াইটাকে তো একদমই ভুলে যাওয়া যাবে না। মাহমুদউল্লাহ অধিনায়ক হওয়ায় টেস্টে সেটি আরও কেন্দ্রীভূত। শততম টেস্টে এই হাথুরুসিংহেই বাদ দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহকে। একাদশ থেকে বটেই, স্কোয়াড থেকেও বাদ দিয়ে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেশেই। আজ সেই মাহমুদউল্লাহ যখন বাংলাদেশের হয়ে টস করতে নামবেন, কেমন লাগবে হাথুরুসিংহের? বা মাহমুদউল্লাহই কি একটু বেশি রোমাঞ্চিত হাথুরুর দলের বিপক্ষে অধিনায়কত্ব করবেন বলে? মাহমুদউল্লাহ অবশ্য বলেছেন, এ নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। সবাই মিলে দলের জন্য কিছু করতে পারাটাই আসল।
দিনেশ চান্ডিমালও একই প্রত্যাশা নিয়ে মাঠে নামবেন। ত্রিদেশীয় সিরিজে চোট পাওয়া অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস দেশে ফিরে যাওয়ার সময় কিট ব্যাগটা ঢাকায় রেখে গেলেও নিজে ফিরে আসেননি এখন পর্যন্ত। প্রথম টেস্টে তাঁকে পাওয়া যাবে না বলেই জানিয়েছেন লঙ্কান অধিনায়ক। যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অধিনায়কের সবচেয়ে বেশি আস্থা রঙ্গনা হেরাথের ওপর, ‘ও যা চায় তাই করতে পারে। দলের জন্য অনেক বড় সম্পদ। আশা করি সে তার কাজটা ঠিকভাবে করতে পারবে। আর আমরাও ফলাফলের চিন্তা বাদ দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেটের ওপর বেশি জোর দেব। বাংলাদেশের জন্য এই টেস্ট অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে।’
শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম টেস্ট পরীক্ষায় হাথুরুসিংহেরও একই চাওয়া। সবাই যেন শক্তির জায়গাটা খুঁজে পায়। গত চার বছরে বাংলাদেশে কোনো টেস্ট না খেললেও এখানে শ্রীলঙ্কার অতীত বেশ উজ্জ্বল। সেই ঔজ্জ্বল্যটাই দেখতে চান দলের মধ্যে। সে জন্য খেলোয়াড়দের সামনে খুলে দিয়েছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝাঁপি। বুঝিয়ে দিচ্ছেন ২২ গজের প্রতিটি ইঞ্চি।
লড়াইটা শেষ পর্যন্ত ওখানেই হবে। টেস্ট সিরিজের সব আলোচনার শেষটাও গিয়ে ঠেকছে সেই উইকেটেই।
পাঠকের মন্তব্য