বিশ্বব্যাংকের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলছেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদেরকে যে স্থানীয় লোকেরা আশ্রয় দিচ্ছেন তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দরকার।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট এ্যানেট ডিক্সন বলছেন, বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গারা আসার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অবকাঠামো এবং পানির উৎসের ওপর তীব্র চাপ পড়েছে।
মিজ ডিক্সন গত পাঁচ দিন ধরে মিয়ানমার থেকে গত ছয় মাসে পালিয়ে আসা ৬ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্যাম্পগুলো সফর করেছেন।
অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুল পরিমাণ লোক আসায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, রোহিঙ্গাদের মতোই তাদের আশ্রয় দানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীরও ব্যাপক সহায়তা দরকার।
উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা এখন দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্রোতের মতো আসা রোহিঙ্গাদের চাপে কৃষি জমি, শ্রম বাজার ও শিক্ষা সহ ওই অঞ্চলের মানুষজনের জীবনের নানা দিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্থানীয় মানুষজন ও উন্নয়ন কর্মীরা জানাচ্ছেন।
কিভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তাদের জীবন? এর জবাবে টেকনাফের নীলা ইউনিয়নের লবণ চাষী, মোহাম্মদ আলী লবণের বলছিলেন, গত আগস্টে ঐ এলাকায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের তিনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার জমিতে থাকার ব্যবস্থা ও খাবার দিয়েছেন।
কিন্তু মি আলী এখন বলছেন, তার মুল পেশা লবণ চাষ এখন একদম বন্ধ হয়ে রয়েছে।
তিনি বলছেন, “আমাদের লবণের ক্ষেত ও চাষের জমি বলতে গেলে ওদের দখলে। আমার জমিতে রোহিঙ্গাদের দুইশ মতো পরিবারের বাস করছে। লবণ চাষের সময় হল শুকনা মৌসুম। বর্ষাকালে লবণ চাষ সম্ভব না। বৈশাখ মাস পর্যন্ত লবণ চাষ করা যায়। কিন্তু বৈশাখ আসতে মাত্র তিন মাস। এর মধ্যে তারা না উঠে গেলে এই মৌসুমে আমি তো চাষই করতে পারবো না”
এই পরিস্থিতি ঐ অঞ্চলের বহু মানুষের। গত বছরের আগস্টের শেষের দিক থেকে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠী পাঁচ লাখের মতো। কিন্তু আগে আসা রোহিঙ্গা সহ ঐ অঞ্চলে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ঐ অঞ্চলের মানুষ এগিয়ে এসেছে এবং এখনো অনেকে সহায়তা করছে।
কিন্তু প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানের ফলে এলাকার মুল জনগোষ্ঠীরও যে সহায়তার দরকার হবে বা স্থানীয়দের কথা ভুলে গেলে যে চলবে না সেটি কেবল অনুধাবন করতে শুরু করেছেন উন্নয়নকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তারা।
কক্সবাজার ভিত্তিক এনজিও শেডের প্রোগ্রাম কো-অরডিনেটর শওকত আলী বলছেন, স্থানীয় মানুষজনের জীবন তাদের উপস্থিতিতে নানা ভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
“রোহিঙ্গারা কৃষি জমিতে আশ্রয় নেবার কারণে কৃষি কাজ বন্ধ রয়েছে অনেকের। অর্থের অভাবে স্থানীয় শ্রমবাজার সস্তায় কাজ করছেন রোহিঙ্গারা। যার ফলে স্থানীয় শ্রমবাজারে আর স্থানীয়দের আর কাজ জুটছে না।”
“টিউবওয়েলের অতিরিক্ত ব্যবহারে তার অনেকগুলোই নষ্ট হয়ে গেছে। এরকম নানা সমস্যায় স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের তিক্ততা বিরাজ করছে”
এছাড়া নীলা ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলী বলছিলেন, টেকনাফে আগে থেকেই বিশুদ্ধ পানির সংকট ছিল। বাড়তি লোকের চাপে সেই পানিতে এখন আরো টানাটানি পড়ছে।
পাহাড় ও গাছ কেটে বাড়িঘর বানানোর কারণে এলাকার জীববৈচিত্র্য ও গাছপালা ঝুঁকির মুখে বলে জানাচ্ছেন উন্নয়ন কর্মীরা। নাফ নদীতে রোহিঙ্গাদের পারাপার বন্ধে নিষিদ্ধ করা হয়েছে জেলেদের মাছ ধরা। তাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এলাকার জেলেরা।
এমন প্রেক্ষাপটে সবমিলিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খুব বিপদের মুখে রয়েছেন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেইনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় তারা কি করছেন।
মি. হোসেইন বলছেন, “স্থানীয় লোকজনের উপর যে ইমপ্যাক্ট পড়ছে বা তারা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেই ব্যাপারে আমাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে তুলে ধরেছি। বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন সহ যে মন্ত্রণালয় গুলো এখানে দরকার তাদের জানিয়েছি। এই ক্ষতির বিষয় ও পরিমাণ নিরূপণ করে কিভাবে তা কাটিয়ে ওঠা যায় সেই ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আমরা আশা করি এ ব্যাপারে এটা সহযোগিতা পাওয়া যাবে”
আলি হোসেইন নিজেই বলছিলেন ঐ অঞ্চলে শিক্ষাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন ও মাঠ ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্কুল কলেজ ব্যবহৃত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের দ্বারাও। সেই আগস্ট মাসে বিষয়টি এভাবে চলাতে ঐ এলাকায় শিক্ষা কার্যক্রম রীতিমতো ভেঙে পড়েছে।
পাঠকের মন্তব্য