মৃত্যুর মাঝখানে বসবাস করেও কিছু ভালোবাসা তৈরি হতে পারে? যখন সবাই নিজের জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত, তখন কি কেউ আরেকজনের জীবন নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে?
ঠিক সেটাই তৈরি হয়েছিল হিটলারের আমলে, হিটলারের এক মৃত্যু ক্যাম্প পোল্যান্ডের আউশভিৎসে।
মনে করা হয় যে, মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধগুলোর একটি ঘটেছে এই আউশভিৎস ক্যাম্পে, যেখানে হাজার হাজার মানুষকে গ্যাস চেম্বারে পুড়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে অনাহারে আর ঠাণ্ডায়। সারা ইউরোপ থেকে হিটলারের বাহিনী এসএসের সদস্যরা ইহুদিদের ধরে ধরে এই ক্যাম্পে পাঠাতো। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আউশভিৎস দখল করে নেয়ার পর সেই বিভীষিকার অবসান ঘটে।
এই ক্যাম্পে আসা লোকজনের প্রথমেই পরিচয় কেড়ে নেয়া হতো। ক্যাম্পে প্রবেশের পর থেকেই তাদের আর কোন নাম থাকতো না। বদলে তাদের বাহুতে একটি নাম্বার লিখে দেয়া হতো। সেটাই হতো তার পরিচয়।
আর সেই বাহুতে ট্যাটু করে সেই নাম লেখার কাজটি করতেন একজন বন্দী, যার নাম্বার ছিল ৩২৪০৭। সম্প্রতি সেই ব্যক্তিকে নিয়ে একটি বই লিখছেন হেথার মরিস যার শিরোনাম ‘দি ট্যাটু অফ অচেস্ট’।
এই বন্দীর আসল নাম লুডউইগ লেল আইসেনবার্গ। শ্লোভাকিয়ায় ১৯১৬ সালে তার জন্ম। ২০০৬ সালে তিনি মারা যান। কিন্তু তার আগে সেই ভালোবাসার গল্প শুনিয়েছেন হেথার মরিসকে।
ক্যাম্পের ট্যাটু শিল্পীর জীবন
যখন তার বয়স ২৬ বছর, ১৯৪২ সালে একদিন নাৎসী পুলিশ এসে তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়।
আউশভিৎস ক্যাম্পে আসার পর অন্যদের মতো লেলের হাতেও ট্যাটু একে দেয়া হয়। তখন পাপেন নামের ফরাসি ট্যাটু শিল্পী তাকে তার সহকারী হিসাবে নিযুক্ত করেন।
একদিন পাপেন নিখোঁজ হয়ে যায়। তার কি হয়েছে তা আর কখনোই জানতে পারেনি লেল। তবে স্লোভাকিয়ান, জার্মান, রাশিয়ান, ফরাসি, হাঙ্গেরি ইত্যাদি ভাষা জানার কারণে তিনি হয়ে ওঠেন প্রধান ট্যাটু শিল্পী।
নতুন বন্দী এলে তাদের হাতে ট্যাটু আকাই ছিল তার একমাত্র কাজ। এজন্য অন্য বন্দীদের তুলনায় তিনি কিছুটা বেশি সুবিধা পেতেন। তিনি একটি একক কক্ষে থাকতেন, পুরো রেশন পেতেন, খেতেন প্রশাসনিক ভবনে।
তবে তিনি কখনোই নাৎসিদের সহযোগী হিসাবে নিজেকে মনে করতেন না। কারণ যা তিনি করেছেন, শুধুমাত্র নিজের জীবন বাঁচানোর জন্যই করতে বাধ্য হয়েছেন।
পরের দুই বছরে শত শত মানুষের হাতে ট্যাটু করে নাম্বার লিখেছেন লেল। হাতে নাম্বার আঁকার পর তাদের নানা নানা কাজে পাঠিয়ে দেয়া হতো। তবে যাদের গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হতো,তাদের হাতে আর ট্যাটু আঁকা হতো না।
বন্দী নাম্বার ৩৪৯০২
১৯৪২ সালের এক সকালে তার হাতে নতুন একটি নাম্বার দেয়া হয়। সেই নাম্বার ছিল ৩৪৯০২। পুরুষদের হাতে ট্যাটু আঁকা এক জিনিস, কিন্তু যখন তিনি এক তরুণীর শীর্ণ হাত ধরেন, তখন তার মনে দ্বিধা এসে যায়। কিন্তু তিনি জানতেন, জীবন বাঁচাতে হলে তাকে এই কাজ করতে হবে।
যখন সেই তরুণীর চোখে তার চোখ পড়ে যায়, তখন যেন কিছু একটা ঘটে যায়।
অনেক পরে এই গল্প তিনি করবেন মরিসের কাছে, যখন তিনি বলবেন, যখন ওই হাতে তিনি ট্যাটু আঁকছিলেন, যখন যেন তিনি নিজের হৃদয়ের উপরই খোদাই করছিলেন।
তিনি জানতে পারেন, তার নাম গিটা। তিনি থাকতেন নারীদের ক্যাম্প বির্কেনাউতে।
পরে নিজের ব্যক্তিগত এসএস গার্ডের সহায়তায় গিটার কাছে চিঠি লিখতে শুরু করেন লেল।
তিনি গিটার যত্ন নিতেও শুরু করেন। নিজের বরাদ্দ রেশন থেকে গিটার জন্য খাবার পাঠাতেন, আশা যোগাতেন এমনকি তার জন্য ভালো একটি কাজের ব্যবস্থাও করে দেন।
গিটা ছাড়াও আরো অনেক বন্দীকে সহায়তা করেছেন লেল। অনেক বন্দী তাদের স্বর্ণালঙ্কার এবং টাকা দিতেন লেলকে, তিনি সেগুলো আশেপাশের গ্রামবাসীদের দিয়ে খাবার সংগ্রহ করে বন্দীদের দিতেন।
রাশিয়ানরা যখন আউশভিৎসে অভিযান চালাতে শুরু করে, তখন যাদের সেখান থেকে মুক্তি দেয়া হয়, তাদের একজন ছিলেন গিটা। কিন্তু লেল জানতেন না, গিটার পুরো নাম কি, তিনি কোথায় গেছেন বা কোথা থেকে এসেছিলেন।
পরে ক্যাম্প থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন লেল।
আবার চার চোখের মিলন
বাড়িতে ফিরে আসার পর লেলের চোখে শুধু ভাসছিল গিটার চেহারা। তখনো তার মনে শুধু এই চিন্তাই ছিল, কোথায় গেলে পাবেন গিটাকে।
গিটার খোজে তিনি ব্রাটিস্লাভা রেল স্টেশনে গিয়ে দিনের পর দিন বসে থেকেছেন, যেখান দিয়ে বেঁচে যাওয়া বন্দীরা বাড়ি ফিরছিলেন। পরে স্টেশন মাস্টারের পরামর্শে তিনি রেড ক্রিসেন্ট ক্যাম্পে রওনা হন।
ক্যাম্পে যাওয়ার পথে রাস্তায় একজন নারী তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। পরিচিত উজ্জ্বল চোখ, পরিচিত একটি চেহারা।
গিটাই তাকে খুঁজে পেয়েছে।
অবশেষে নতুন ঠিকানা
এই যুগল ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে বিয়ে করে। এরপর তারা নিজেদের শেষ নাম বদল করে চেকোস্লোভাকিয়ায় বসবাস শুরু করে।
লেল সফলভাবে একটি কাপড়ের দোকান শুরু করেন। পাশাপাশি তারা একটি ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থসংগ্রহ করে সেগুলো পাঠাচ্ছিলেন। সরকার সেটি জানতে পারলে লেল আটক হন।
মুক্তি পেয়ে এই দম্পতি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। এরপর মেলবোর্ন হয় তাদের নতুন ঠিকানা। সেখানেই নতুন করে আবার কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন লেল আর ডিজাইনিং শুরু করেন গিটা ফুহরমানোভা।
কিন্তু কখনোই তিনি এই গল্প প্রকাশ করেননি বা আসল নাম প্রকাশ করেননি। কারণ তাদের ভয় ছিল, হয়তো এটা জানাজানি হলে লোকে তাকে নাৎসিদের সহযোগী মনে করে বিচার করতে পারে।
এই দম্পতির একটি সন্তান হয়। সেখানেই তাদের জীবনের বাকি সময়টা কাটে।
গিটা অবশ্য পরে কয়েকবার ইউরোপে গিয়েছেন, কিন্তু লেল আর কখনোই অস্ট্রেলিয়ার বাইরে যাননি।
শুধু খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজনই জানতেন এই যুগলের প্রেম কাহিনী।
আর আজ আপনিও জানলেন…
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা।
পাঠকের মন্তব্য