পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফেরেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডন থেকে দিল্লি পর্যন্ত যাত্রাটি ছিল ১৩ ঘণ্টার। এই উড়োজাহাজে যাঁরা তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুই ভারতীয় কূটনীতিক—ভেদ মারওয়া ও শশাঙ্ক ব্যানার্জি। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে আলাদা সাক্ষাৎকারে তাঁরা এই বিমানযাত্রার স্মৃতিচারণা করেছেন। ২০০৮ সালে দিল্লিতে ভেদ মারওয়া ও ২০১৩ সালে ঢাকায় শশাঙ্ক ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। শশাঙ্ক ব্যানার্জি এই যাত্রাকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিশন হিসেবে উল্লেখ করেন।
ওই যাত্রার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁরা জানান, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরতে উদ্গ্রীব ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধু কখনো কখনো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তবে দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই তিনি একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো বাস্তববাদী বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে ঢাকা থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরে যাওয়া দ্রুত করার ব্যাপারে তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করেন সেই বিমানযাত্রাকালেই।
’৭২ সালে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে প্রথম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ভেদ মারওয়া। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাত্রাপথের স্মৃতিচারণা করে ভেদ মারওয়া বলেন, ‘লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে আমরা একটি বিশেষ বিমানে চাপলাম। আমাদের যাত্রাপথ ছিল হিথরো থেকে প্রথমে নিকোশিয়া (সাইপ্রাস), সেখান থেকে বাহরাইন, বাহরাইন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা। বিমানে আমরা চার থেকে পাঁচজন লোক ছিলাম। শেখ মুজিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন, আমি এবং শশাঙ্ক ব্যানার্জি।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ কারাবাস সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে বেশ চাঙা দেখাচ্ছিল। সবকিছুতেই তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ কাজ করছিল। তিনি আমাকে তাঁর পাশের আসনে বসার জন্য ডাকলেন। তিনি যখন বুঝলেন, আমি বাংলা বুঝতে পারি ও বলতে পারি, তখন আমাদের মধ্যে দ্রুত একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেল। একজন তরুণ হিসেবে শেখ মুজিবের মতো ব্যক্তিত্বের পাশে বসার অভিজ্ঞতা আমাকে সেদিন ভীষণ রোমাঞ্চিত করেছিল। তখন শেখ মুজিবকে কথায় পেয়ে বসেছিল। তিনি আমার সঙ্গে কেবল কথা বলার জন্যই কথা বলেননি। তাঁর বলার ভঙ্গি ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা।’
ভেদ মারওয়া জানান, বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তাঁর যত চিন্তা ছিল বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি জানতেন না তাঁর ভাগ্যে কী আছে। কী ঘটতে পারে, এটা নিয়েও তাঁর চিন্তা ছিল না। পাকিস্তানে বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। তাঁর কথাবার্তায় ঘুরেফিরে আসছিল সদ্য জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সমস্যার কথা।
মারওয়া বলেন, ‘আমাকে বলা কথাগুলো ঢাকায় অবতরণের পর রমনা ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া সেই বিখ্যাত ভাষণেও তিনি বলেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, বিমানে ভ্রমণের সময়ই তিনি বক্তৃতায় কী বলবেন, তা মনে মনে গুছিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ওই ভাষণ শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন, আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল।’
ওই দিনের স্মতিচারণা করতে গিয়ে সে সময় লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি জানান, বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। তাঁকে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ব্যানার্জি, এখানেও আছেন!’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন ইয়ান। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। আধঘণ্টা ধরে ফোনে ইন্দিরার সঙ্গে কথা বলেন মুজিব।
শশাঙ্ক বলেন, ‘বিমানে পাশের আসনে বসলাম। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। দেশে ফেরার তর সইছে না উৎফুল্ল মুজিবের।
‘আপ্লুত কণ্ঠে শেখ মুজিব বললেন, “স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। ব্যানার্জি, এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।”
-বললাম, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’
-ধীরলয়ে মুজিব বললেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তাঁর কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার এ নিয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশের ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।’
‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” তাঁর চোখ ভরে উঠেছে জলে। বললেন, “ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।”
‘দুজনে মিলে গানটা গাইলাম। বঙ্গবন্ধু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরও কঠোর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। বুকে শুধু একটাই বল, আমার দেশের আপামর মানুষ।’
‘আমাকে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, “এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?”
‘আমি বললাম, “ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
‘বিমানের যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধুকে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার অনুরাধ জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বার্তা এল। কলকাতাবাসী বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চায়। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিরতি বার্তায় জানালেন, স্বাধীনতাসংগ্রামে কলকাতাবাসীর সহযোগিতা তাঁকে কৃতজ্ঞ করেছে। কিন্তু দিল্লি হয়ে ঢাকা ফিরতে তাঁর তর সইছে না। তবে শিগগিরই তিনি কলকাতা যাবেন।
-বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘পথ তো মনে হয় ফুরাতে চাইছে না। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ, মানুষ, প্রকৃতি আমাকে ডাকছে। এ যে কী অনুভূতি, আমি বোঝাতে পারব না!’
-আমি বললাম, ‘দিল্লি অবতরণের তখন আর সময় বেশি বাকি নেই। পাইলট আমাদের দুটি ছবি তুলে দিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে তোলা সেই ঐতিহাসিক ছবিটি এখনো খুব যত্ন করে তুলে রেখেছি।’
পাঠকের মন্তব্য