চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন প্রান্তিক মানুষের সংবাদকর্মী। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনপদের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও ছবি জাতীয় পত্রিকায় তুলে ধরে আড়োরণ সৃষ্টি করেছেন। তার লেখা ছোটখাটো সংবাদও পাঠক প্রিয়তা পেয়েছিল। তার আগে অন্য কেউ জাতীয় গণমাধ্যমে গ্রামের সংবাদকে এতোটা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরণে পেরেছেন বলে জানা যায় না। ডেস্কে বসে সাংবাদিকতায় নির্ভর না হয়ে গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নতুন মাত্র সৃষ্টি করেছেন। তিনি দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টিং এর মাধ্যমে নতুন মাত্র যোগ করেছিলেন। তিনি পুরো উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনপথ ঘুরে খবরের পিছে লুকিয়ে থাকা খবরের তথ্যানুসন্ধান করে প্রতিবেদন তৈরী করতেন। এ জন্য তিনি চরণ সাংবাদিক হিসাবে সমাধিক পরিচিত।
২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ২২তম মৃত্যু বার্ষিকী। এই দিনে গাইবান্ধা ফুল ছড়ি উপজেলার যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে ২টি নৌকা ডুবির তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের শেরেবাংলা ফেরী ছাদ থেকে নদী পানিতে পড়ে মৃত্যু বরণ করেন। এ অকাল মৃত্যু ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক হৃদয় বিদয়ক। তিনি বাহাদুরাবাদগামী ফেরীটির কালাসোনার টার্ণিং পয়েন্ট অতিক্রম কালে ছবি তোলার জন্য ফেরীর ছাদে উঠেছিলেন। আর সেখান থেকে পড়ে তার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। বহু সংবাদকর্মীসহ প্রিয়জনদের কাঁদিয়ে তথ্যানুসন্ধানী এই সাংবাদিক কর্তব্য পালন কালেই না ফেরার দেশে চলে যান। তিনি সাতার জানতেন না, তিনি পানিকে ভয় করতেন, আর সেই পানিতেই পড়ে তার প্রাণ দিতে হলো। ৩০ ডিসেম্বর ভালবাসায় সিক্ত হাজার মানুষের শ্রদ্ধায় তাকে রংপুর শহরে মুন্সিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।
চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্ণেয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে জন্ম তারিখ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। (১৮ জুন, ২৭ জুন) তার পিতা আলীমউদ্দীন আহমদ ও মাতা মতিজান ন্নেছা, স্ত্রী নাছিমা আখতার ইতি। তিনি ৩ সন্তানের জনক ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। বগুড়া বুলেটিং পত্রিকার মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকার দৈনিক আওয়াজ পত্রিকায় স্থানীয় প্রতিনিধি হিসাবে কাজ শুরু করেন। এরপর কিছুদিন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা এবং ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদে কাজ করার সুযোগ পান। সংবাদে কাজ করার সময় থেকে তার প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততার কারণে তিনি সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন। একটানা ২০ বছর সংবাদে কাজ করার পর ১৯৯৫ সালে তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে যোগদান করেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার কারণে কেউ রুষ্ট হলেও তার আদর্শ থেকে তিনি বিচলিত হননি। তিনি সাংবাদিকতার বর্ণাঢ্য জীবনে অর্জন করেছে বহু পুরস্কার। একুশে পদক, ফিলিপস পুরস্কার, অশোকা ফেলোশীপ, জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক সহ বহু সম্মননা অর্জন করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে রংপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক রংপুরের সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি নাটক, গল্প, ছড়া-কবিতা সহ সাহিত্যকর্মে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। তার লেখা বিভিন্ন সংবাদ, সংবাদের পিছনের ঘটনা নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। এরমধ্যে পথ থেকে পথে, কালাসোনার মুখ, পায়রা বন্দরে শেকড় সংবাদ, চিতলমারি একযুগ উল্লেখ যোগ্য। তার সকল রচনা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মোনাজাত রচনাবলি।
মোনাজাতউদ্দিন নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল সাংবাদিক ছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সময়, ঘন্টা, দিন-রাত বলে বাঁধাধরা কোন নিয়ম ছিলনা তার কাছে। তিনি সব সময় সংবাদের পিছনে ছিলেন। সে সময় গ্রাম থেকে একটি সংবাদ ও সাদা-কালো প্রিন্ট করা ছবি ঢাকায় পত্রিকা অফিসে পাঠানো ছিল দুরুহ ব্যাপার। বাস-ট্রেন বা বিশেষ ব্যবস্থায় বাহকের মাধ্যমে সংবাদ পাঠানো ছিল অনেক ঝুকি ঝামেলার। তবে মোনাজাতউদ্দিনের মত দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষে তা ছিল সম্ভব। অফিস অ্যাসাইনমেন্ট পালনেও তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তার সংবাদ লেখার বৈশিষ্ঠ ছিল সরেজমিনে, তথ্য সংগ্রহে তার যেমন ছিল কলাকৌশল, তেমনি সংবাদ তৈরির পরিকল্পনা ছিল নিয়ম মাফিক। তিনি ছিলেন নির্ভিক ও মতপ্রকাশে সোচ্চার। তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা তৃণমূলের সাংবাদিকদের পথ দেখাতো ও দিক নির্দেশনা দিতো। তার লেখার ধরণ, বাক্য ও শব্দ চয়ন এবং সংবাদ উপস্থাপনার কলাকৌশল থেকে শেখার রয়েছে। যাহা গ্রামীন সাংবাদিকতার জন্য খুব জরুরী। মোনাজাতউদ্দিনের আদর্শ অনুসরণ করলে যে কোন সাংবাদিক পেশায় কুলষ মুক্ত থাকতে পারে। মোনাজাতউদ্দিনের রচনাবলি রপ্ত করলে সাংবাদিকদের অনুসন্ধানি চোখ খুলতে সহায়তা করবে। তার আদর্শে উজ্জীবিত হলে বিবেকের দ্বার খুলবে। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তাকে স্মরণ করি।
পাঠকের মন্তব্য