জলবায়ু পরিবর্তনে ক্রমাগত হুমকির মুখে উপকূল। পরিবেশ দূষণ বেড়েছে। কমছে সবুজের সংখ্যাও। দুর্যোগের ধাক্কায় এখনোও প্রাণ কেড়ে নেয়। তবুও সচেতন নয় মানুষ। ফলে এখানকার জীবন-জীবিকায় বিরূপ আঘাত ক্রমেই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে চাই সবুজ সচেতনতা। আন্দোলন চাই সবুজের জন্য। এমনি একটি কর্মসূচির নাম “সবুজ উপকূল”। গ্রীণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে যার পৃষ্ঠপোষক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। ২০১৫ সাল থেকে টানা ৩ বছর কর্মসূচিটি চলছে।
পূর্বে টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম। এই ৭১০কিলোমিটার তটরেখা জুড়ে বিস্তৃত পরিসরে মাঠ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিলো। ইতিমধ্যে টানা ৩ বছর সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকায়। যেখানে দেশের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। মাঠ কর্মসূচির আওতায় ছিলো র্যালী, আলোচনা সভা, সবুজ বিষয়ক সৃজনশীল প্রতিযোগিতা, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, বক্তব্য, উপস্থাপনা, গাছের চারা লাগানো। পড়ুয়ারা নিজেরাই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, নিজেরাই অসাধারণ বক্তা।
সবুজ উপকূল অনুষ্ঠানগুলোতে বিশিষ্টজনদের মুখ থেকে পড়ুয়ারা শুনেছে, সবুজ কেন দরকার? কেনই বা সবুজের সুরক্ষা জরুরী? কিংবা এই সবুজ সুরক্ষায় তাদের ভূমিকা কী হতে পারে? এভাবেই পড়ুয়ারা উপকূলের সবুজ সম্পর্কে সজাগ হচ্ছে। উপকূলের শিক্ষার্থীদের বৃহৎ এক অংশ এখন এই কর্মসূচির ছোঁয়ায় এসে জীবন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে। ওদের কেউ এখন গাছ লাগায়, কেউ গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করছে মানুষকে। সবুজ নিয়ে লেখা, বলা, চিত্রাঙ্কনে এগিয়ে ওরা। উপকূলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকজন সবুজ যোদ্ধা’র খন্ডচিত্র-
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের তোয়াহা স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির নুসরাত জেবিন জেসিয়া। তাদের বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত “সবুজউপকূল-১৬” তে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয় তার। সে বক্তব্য দিয়েছে, দেয়াল পত্রিকায় লিখে পুরস্কারও জিতেছে। পুরস্কার পাওয়ার আনন্দে সবুজের প্রতি তার ভালোবাসা এখন নিবিড়। এবার “সবুজ উপকূল” কর্মসূচিতে নতুন যুক্ত হওয়া পরিবেশ পর্যবেক্ষণে সে গিয়েছে। দলের সদস্যের নিয়ে তার তৈরিকৃত প্রতিবেদন চমৎকারভাবে অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করে সে। একদিকে সে যেমন নিজে সবুজ সচেতন। অন্যদিকে তার মাধ্যমে অন্যরাও সবুজ সুরক্ষায় সচেতন হচ্ছে।
নিজ অনুভূতি প্রকাশ জেসিয়া বললো, “এটি এমন একটি সৃজনশীল কর্মসূচি, যা আমাদের চিন্তার জগতকে প্রসারিত করেছে। পরিবেশ পর্যবেক্ষণে গিয়ে আমি সংকট অনুসন্ধান করার যে পদ্ধতি শিখেছি, তা আমার বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবো।”
চট্টগ্রামের বাঁশখালী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নুসরাত তাসনীম ও নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাটা খাসেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অভি মজুমদার। বয়সের দিকে থেকে ওরা এখনো অনেক ছোট। দু’জন অসাধারণ উপস্থাপক। রাজধানীর বাংলামটরের বিশ্বসাহিত্যে কেন্দ্রে “সবুজ উপকূল-১৬” সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পুরো অনুষ্ঠান ওদের উপস্থাপনায় শেষ হয়। প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশিষ্টজনদের থেকেও। ওরা এখন ব্যতিক্রমীভাবে সবুজ সুরক্ষার আহবান জাগাচ্ছে তাদের সীমারেখার বাহিরেও।
দু’জন বললো,”আমরা যে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে পারবো, তা কখনই ভাবিনি। কিন্তু এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে শিখেছি। আমরা এখন আমাদের বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলোও উপস্থাপন করি।”
বিন ইয়ামিন সিফাত ও দিদার আহমেদ। ভোলা জেলার দক্ষিণের একটি জনপদ মনপুরা দ্বীপের হাজীরহাট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০১৫ সালে “সবুজউপকূল” কর্মসূচিতে অংশ নেয়। সিফাত এখন ঢাকা বিজ্ঞান কলেজের দ্বাদশের ছাত্র। আর দিদার স্থানীয় একটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে অধ্যয়নরত। দু’জনেই স্থানীয় বন্ধুদের নিয়ে সবুজ সচেতনতায় কাজ করে যাচ্ছে। পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবুজ সুরক্ষার প্রচারণায় লেখালেখিও করছে দু’জন। দ্বীপে গাছ লাগালে দুর্যোগে নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদের এই প্রয়াস অব্যাহত।
খুলনার পাইকগাছার সুখদা সুন্দরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী আরজু সুলতানা হ্যাপি। “সবুজ উপকূল” কমসূচির গোড়ার দিকেই যুক্ত সে। সৃজনশীল প্রতিযোগিতার অংশ রচনায় প্রথম স্থান এবং কবিতা দ্বিতীয় স্থানের পুরস্কার জিতেছে সে। উপকূল নিয়ে লেখালেখি করে সে। সেক্ষেত্রে উপকূলের সবুজ বাঁচানোর তাগিদ তুলে ধরে তার কবিতা, রচনা ও প্রতিবেদনে। ইতিমধ্যে তার সহপাঠীরাও তার ইতিবাচক কাজে পাশে দাড়িয়েছে। ওদেরকেও সে উপকূলের সবুজ গাছপালা নিয়ে লেখালেখি করার তাগিদ দিচ্ছে।
কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ হাজী বশির আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ওমর হায়াত তাহসান ও মো. ইসহাক শাহ। ওদের বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠিত সবুজ উপকূল অনুষ্ঠানে তাহসান বক্তব্য দিয়েছিলো। অন্যদিকে ওরা দু’জনে মিলে পুরো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছে। দু’জনেই এখন খুদে সংবাদকর্মী। লিখছে নিয়মিত। ওদের ভেতর সবুজ সচেতনতা বেড়েছে। ওরা অন্যদেরও লেখালেখি, বক্তব্য, উপস্থাপনার মাধ্যমে সবুজ সুরক্ষায় দক্ষ করে তুলছে।
তাদের মতই নোয়াখালী সুবর্ণ চরের এ. এম.রাফিদুল্লাহ। ভোলার রিয়াজ আহমেদ, হাবিব আদনান। লক্ষ্মীপুরের শাহিনুর আক্তার শানু, রাবেয়া বসরি, মাহি আক্তার, তানভী বিন লিয়াকত, শাওন আহমেদ। চাঁদপুরের হাইমচরের রেহমুনা মাহজাবিন রাদিন, সুমি আক্তার। ওরা উপকূলের সবুজ সুরক্ষায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদের মতই নাম না প্রকাশ করা অসংখ্য তরুণ এখন “সবুজ উপকূল” কর্মসূচির ফসল।
পাঠকের মন্তব্য