এক টুকরা উন্নয়ন ভেঙে পড়েছে, তাতে এক চিলতে এক মানুষ মারা গেছেন। বড় কেউ নন। একজন মামুলি কাঠমিস্ত্রি। বাড়তি টাকার জন্য রাতে উড়ালসড়কের কাজ করছিলেন। নির্মাণাধীন সেই সড়কের একটা গার্ডার ক্রেন দিয়ে তুলতে গেলে পড়ে যায়। আর পড়বি তো পড় দুর্ভাগা ওই কাঠমিস্ত্রিসহ আরও দুজনের ঘাড়ে। ২০১২ সালে চট্টগ্রামে উন্নয়নের আরও বড় টুকরা ভেঙে পড়েছিল। উড়ালসড়কের ধসে সেবার মারা যান ১২ জন। গত বছরের মার্চ মাসে এই মগবাজারেই মারা যান এক শ্রমিক। এ ধরনের মৃত্যু ঘটছেই। তাঁদের আমরা কী বলব, উন্নয়নের শহীদ? অবহেলাজনিত এ অপমৃত্যুর জন্য দায়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি চাওয়া উচিত। ৯৮ টন ওজনের এই জিনিস যদি দিনের বেলার জনাকীর্ণ রাস্তায় পড়ত! এই অঘটন তদন্তে একটা কমিটি করা হয়েছে। আমরা আশা করব, কমিটি একজনের মৃত্যু এবং দুজনের একটি করে পা হারানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করবে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহ আইন মোতাবেক ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশ করবে। কিন্তু তদন্তকাজের আওতাটা কি আরেকটু বাড়াবেন তাঁরা? ভুক্তভোগী মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু কথা তাঁদের শুনতে হবে।
এ সড়ক বানানোর চুক্তিতে মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৬০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন এই খাতে অারও যুক্ত হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি । আর সময়ের হিসাব? এখন ২০১৭ সালের মার্চ মাস গেলেও আগামী জুনেও কাজ শেষ হবে বলা যাচ্ছে না। এ সময়ে ওই এলাকা দিয়ে চলাচল করা লাখো মানুষ প্রতিদিন চলাচলে যে অমানুষিক কষ্ট ভোগ করেছে, তার আর্থিক মূল্য কে ধরবে? কারও প্রাণ গেল, আর কত কত লোক কত কষ্ট ভোগ করল, তার বিচার কী হবে? কেউ কি ব্যাখ্যা করবে, কেন এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই উড়ালসড়ক নির্মাণের ব্যয় সবচেয়ে বেশি?
জনগণের জীবন, শান্তি, প্রাণ আর করের টাকার এত বড় নয়ছয় কেন মেনে নিতে হবে?
ঘটনা অন্য রকমও আছে। বাংলাদেশে ব্যয় দফায় দফায় বাড়ে। আর দিল্লিতে ব্যয় কমে। পার্থক্যটা ঘটান একজন ব্যক্তি। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের তত্ত্বাবধানে আট লেনের একটি উড়ালসড়ক নির্মাণ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল খরচ বেঁচে গেছে ২০ কোটি রুপি। আর কাজটি তাঁরা শেষ করেছেন মাত্র আট মাসে!
দুই.
বাংলাদেশের উন্নয়ন এক সরকার বা এক দশকের অবদান নয়। ১৯৭২ সাল থেকেই ভালোমন্দের দোলায় দুলতে দুলতে আমরা এত দূর এসেছি। আমার বিশ্বাস, এ দেশে সচেতনভাবে কেউ উন্নয়নবিরোধী নয়। উন্নয়নবিরোধী কিছু যদি থেকে থাকে, তা হলো দুর্নীতিতন্ত্র ও সংঘাতের রাজনীতি। শুধু একটি উড়ালসড়ক নির্মাণে যে অপচয় ঘটল, তা কি দুর্নীতি ছাড়া হতে পারত? দুর্নীতির চেয়েও বড় বিপদ আছে। দুর্নীতিতে ক্ষতি হয় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। কিন্তু ভুল নীতির জন্য গচ্চা যায় পুরোটাই। উড়ালসড়কের উদাহরণটাই দেখা যাক। ঢাকায় অনেক উড়ালসড়ক হলো। কিন্তু যানজট কি কিছুমাত্র কমেছে?
তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকায় নির্মিত উড়ালসড়ক কত শতাংশ মানুষের জন্য বানানো হচ্ছে? ঢাকার মোট চলাচলের মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশের হয় প্রাইভেট গাড়ি দিয়ে, যদিও তা দখল করে রাখে সড়কের ৪০ শতাংশ জায়গা। বাস আর রিকশা যথাক্রমে ৭ ও ৪১ শতাংশ জায়গা নিয়ে ঘটায় ২৮ ও ৫৩ শতাংশ চলাচল (ডিইউটিপি ২০০৫)। উড়ালসড়কের সম্পূর্ণ সুবিধা পাবে এসব ব্যক্তিগত গাড়ি, যা আসলে ঢাকার যানজটের জন্য দায়ী। রিকশা ও লোকাল বাসযাত্রীদের বড় অংশকে বহন করলেও তাদের অবস্থা হবে আরও করুণ। উড়ালসড়কের থামগুলোর জন্য জায়গা দিতে, ওঠানামার জায়গা ছেড়ে দিতে নিচের রাস্তাগুলো হয়ে পড়ছে আরও সরু, বাধাযুক্ত। ঢাকার সিংহভাগ মানুষেরই ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। ভগ্নাংশের চলাচল সমস্যার সমাধানকে সবার সমাধান হিসেবে গিলিয়ে দেওয়াই কি উন্নয়ন? যে সুবিধা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের মাথার ওপরের সড়ক দিয়ে চলে যাবে, তা কেমন উন্নয়ন, কার উন্নয়ন?
এর উত্তরও দুর্নীতির বিশ্লেষণের মধ্যে পাওয়া যাবে। ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান হিসেবে ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ফর ঢাকা’ প্রণয়ন করা হয়। এই পরিকল্পনা উড়ালসড়ক সমর্থন করে না (ডেইলি স্টার, ১৪-১১-০৯)। মগবাজার উড়ালসড়ক বানানো হচ্ছে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি দিয়ে। এককথায়, এ ধরনের প্রকল্প হলো রাষ্ট্রীয় তহবিলকে কায়েমি গোষ্ঠীর হাতে পাচারের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি। এভাবে অবিশ্বাস্য বেশি ব্যয় ধরার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় তহবিল ক্ষমতা ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর কাছে চালান দেওয়ার বন্দোবস্ত হলো আমাদের উন্নয়নের কাফ্ফারা। এমন দুর্নীতিভরা, অদক্ষতা ও গাফিলতির শিকার হয়ে মানুষের মৃত্যু হলে তাকে কি আর দুর্ঘটনা ভেবে সান্ত্বনা পাওয়া যায়?
তিন.
জাটকা ধরার জাল ধ্বংসে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৯০০ কোটি টাকা! এটাও উন্নয়নের মডেল। অথচ যারা অভাবের তাড়নায় নিষিদ্ধ মৌসুমে জাটকা ধরে, এ পরিমাণ টাকা দিয়ে তাদের বিকল্প জীবিকা দিলে কিছু পোড়াতেও হয় না, নিম্নমধ্যবিত্ত রাষ্ট্রের এতগুলো টাকা আগুন জ্বালাতেও খরচ হয় না। উন্নয়ন মানে গ্যাসের দাম বাড়ার চেয়ে মানুষের দাম বাড়া, ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বাড়া। উন্নয়ন হলো কর্মক্ষম চার কোটি বেকার, যাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশই শিক্ষিত, তাঁদের কাজ দেওয়ার বন্দোবস্ত করা। উন্নয়নের প্রতীক সাবমেরিন নয়, উন্নয়নের প্রতীক সুশিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান ও মর্যাদার অধিকার পাওয়া এক মানবসমাজ।
চার.
বলা হয়, ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই বলেছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’ (Im the State)। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা যা কিছু ভালো অর্জন, তা তাঁদেরই অবদান হিসেবে তুলে ধরতে চান। তাঁরা না থাকলে কোনো ভালোই নাকি হতো না। রাষ্ট্র তাঁদের হাতে অপার ক্ষমতা দিয়েছে। সব ক্ষমতা হাতে নিয়ে, সবার জীবন-মরণের মালিক হয়ে, সব জবাবদিহির বাইরে থেকে কার্যত তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ‘রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠেন। মুখে না বললেও প্রচারে-ব্যবহারে, পোস্টারে-স্লোগানে, কাজে ও আচরণে তাঁরা সেটা হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়েও দেন। জবাবে আমাদের এটুকুই বলার থাকে, আসুন, দেখে যান, ‘রাষ্ট্র’ কেমন রেখেছে আমাদের!
কিন্তু যত ভালো ও দক্ষই একজন হন, রাষ্ট্র কয়েকজনের বিষয় না। রাজনীতি ও প্রশাসনের স্তরে স্তরে দক্ষতা ও সততা না থাকলে পুরোটাই নৈরাজ্যে নিপতিত হবে। যত বড় প্রকল্প আমরা নিচ্ছি, ততটা দক্ষতা ও নিষ্ঠা আমাদের আছে কি? দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে সবাইকে দূরে ঠেলার পরিণতি ভালো হয় না।
সেই খারাপটা আপাতত জনগণই আগে টের পাচ্ছে। ‘আই অ্যাম দ্য স্টেট’-এর বিপরীতে তাদের দেখাবার বিষয়: ‘দ্য স্টেট উই আর ইন’, -অর্থাৎ যে অবস্থায় আমরা বেঁচে আছি!
এই যেমন উড়ালসড়কের নিচে ঘন যানজটে বসে বসে ঘামছি আর ভাবছি, ভেঙে পড়বে না তো? রডের বদলে বাঁশ দেয়নি তো?
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
পাঠকের মন্তব্য