উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। যার পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে ভয়াল মেঘনা। মেঘনা বেশ খরস্রোতা এজন্যই ভয়ংকর। কেড়ে নেয় মানুষের স্বপ্ন। তার
তাড়ানোতে নিঃস্ব করে তোলে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক পরিবারগুলোকেও। এক সময় যাদের ছিলো ধান ভরা মাঠ, গোয়াল ভরা গরু ছিলো। ছিলো নারিকেল-সুপারির সুবিশাল বাগান, আম গাছ, কাঁঠাল গাছ, বিশাল সম্পত্তির ভিটে-মাটি আরো কত কী। কিন্তু নিষ্ঠুরতা মেঘনার! যুগ যুগ ধরে যার ভাঙ্গন
খেলায় ভিক্ষার থালা এখন অনেকের হাতে।
অনেক আবার হয়েছেন মানসিক রোগীও! মেঘনার ভাঙ্গন প্রত্যক্ষ করলে যেন হৃদয়টাও ভেঙ্গে যায়। আহ ভাগ্য! তিল তিল করে গড়া তোলা সম্পদ আজ মেঘনার রাক্ষুসে হানায়। মানুষের ভাগ্য গিলে খাচ্ছে মেঘনা। যেখানে ছিলো পর্যটন বিকাশের অফুরন্ত সম্ভাবনা, সেখানে আজ জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবের চিত্র চোখে পড়ে। যেন ভাঙ্গনের গন্ধও তাড়ায় মানুষকে। কিছুতেই যেন প্রমত্ত মেঘনা থামছেই না। ভাঙ্গন কবলিত পরিবারের মানুষগুলোর আর্ত্মনাদ ভারী হয়ে ওঠে মেঘনাতীরের আকাশ। সব কিছু হারাতে হয়, নিঃশেষটুকুও থাকেনা পূর্ব স্বজনদের কবরের। বহু সময় ধরে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকা মানুষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন। বছরের একবারও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখার সুযোগ হয়না অনেকের। কূলের ভাঙ্গনে একই সাথে বসতি বাঁধা পরিবারের সদস্যরা ভাঙ্গনে নিঃস্ব হয়ে অন্যত্র এলোমেলো ক্ষিপ্তভাবে বাড়ি-ঘর গড়ে তোলেন। কাউকে কাছে না পেয়ে মানুষজন কেবল সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণার দিকে চেয়ে আছেন। সবারই বিশ্বাস, স্রষ্টা ছাড়া এমন সংকটময় পরিস্থিতি থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবেন। সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রবল আনুগত্যে ওদের চোখের জল মাটি ভিজে।
লক্ষ্মীপুরের দু’টি উপজেলা কমলনগর ও রামগতি মেঘনার এই ভাঙ্গন বেশ তীব্র। এর দক্ষিণেই বঙ্গোপসাগর। দীর্ঘ দিনের মেঘনার ভাঙ্গন মানুষের মনটাকেও ভেঙ্গে দিয়েছে। কারো ঘাঁড় সোজা করার সুযোগ মিলছেনা। মেঘনা ভেঙ্গেছে, অন্যত্র সরিয়ে ক্ষণিকের আশ্রয়। আবারও মেঘনার হানা। এভাবেই বহু পরিবার অসংখ্য বার মেঘনার ভাঙ্গনের শিকার। সূত্র বলছে, মেঘনার এই অনিয়ন্ত্রিত ভাঙ্গন লক্ষ্মীপুরের মানচিত্র অনেকটাই গিলে খেয়েছে। এখনো থামেনি এর ভাঙ্গন। তীব্র ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে ভিটে-মাটি, বহু সাধনায় অর্জিত সম্পদ আর বিস্তৃর্ণ এলাকা। যুগের পর যুগ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বহু সরকারি- বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ নদীর গহীন তলদেশে। অসংখ্য শৈশবের মক্তব, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই এখন মেঘনা পেটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নাব্যতা সংকটে এমন তীব্র ভাঙ্গন।
মেঘনার ভাঙ্গনের কবলে পড়া গ্রামগুলোর মধ্যে এটিও অন্যতম কমলনগরের লুধুয়া ফলকন এলাকা। ভাঙ্গনের প্রকট শব্দে ঘুম হয় না মানুষের। সারা রাত জেগে জেগে ভিটে-মাটি পাহারা দিয়ে থাকেন মানুষজন। এমনই পরিস্থিতির কথা বলছেন ভাঙ্গন কবলিত মানুষ। ভাঙ্গনে নিঃস্ব হওয়ার পথে বসেছেন ৯০বছরের বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম। প্রচুর অর্থ-সম্পদ মেঘনায় ভেঙ্গে গেছে। কোথাও ঠাঁই নেই ভালোভাবে মাথা গোঁজাবার। মেঘনার তীরে গিয়ে চোখে পড়ে তার ছোট্ট একটি ঘর। এরই মাঝে তার বসাবস। এমন সমস্যার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “কী আর করবো বাবারে? আমাগো সব গাঙ্গে নিয়ে গেছে। আমাগো আর কিছুই নাই।”
এভাবেই আহাজারি করতে থাকেন। এ পরিবারগুলোর আশা নদীতো সব বিলীন করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকার থেকে কোন সাহায্য- সহযোগিতা পেলে তারাও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখবেন। ভাঙ্গনে অসহায় এই বাস্ত্যুচূত মানুষের জীবন চলছে এখন মানবেতরভাবে। ভাঙ্গন প্রতিরোধে সরকারিভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য স্বল্প পরিসরে বরাদ্দ হলেও ইতিমধ্যে নিম্মমানের কাজের নানা অনিময়ের অভিযোগ উঠছে। রামগতির আলেকজান্ডারের সাড়ে তিন কিলোমিটার অংশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে সেনাবাহিনী।
অন্যদিকে এরই পাশ্ববর্তী কমলনগরের এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ পায় ঠিকাদারী একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে নিম্মমানের উপকরণ দিয়ে কাজের কারণে এ পর্যন্ত বেড়িবাঁধটি ধসে পড়েছে ৪বার! এমনে খবরে আশাহত মানুষজন। ভাঙ্গন এলাকা অনুযায়ী বাজেট খুবই সামান্য। ৩৭কিলোমিটার জুড়ে মেঘনার এই ভাঙ্গন প্রতিরোধে প্রয়োজন বরাদ্দ বাঁড়ানোর। স্থানীয় কৃতি সন্তান ও লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের গন্থাগারিক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, “নদী ভাঙতে ভাঙতে এখন মেঘনাতীর রক্ষা বাঁধের দু’পাশের অনেকাংশ বিলীন। বেশ কয়েকদিন ধরে বিশেষ করে লুধুয়া এলাকায় ভাঙছে ব্যাপক আকারে। এতে করে বাঁধ টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন হবে।”
কমলনগর- রামগতির ভাঙ্গন প্রতিরোধে সেনাবাহিনী দ্ধারা বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে অসহায় নিঃস্ব মানুষের পাশে দাঁড়াবে সরকার,
এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন মহলের।
পাঠকের মন্তব্য