ক্ষুধার্ত মেঘনা আর ভাঙ্গা সেতুর মৃত্যুফাঁদে অসহায় কালকিনিবাসী

কাঠ আর গাছের গুঁড়ি দিয়ে জোড়া দেয়া ভাঙ্গা সেতুটি এখন মৃত্যুফাঁদ।Junayed Al Habib
কাঠ আর গাছের গুঁড়ি দিয়ে জোড়া দেয়া ভাঙ্গা সেতুটি এখন মৃত্যুফাঁদ।

চর কালকিনি - মেঘনার তীরে অবস্থিত উপকূলীয় এক প্রান্তিক জনপদ। এটা লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার ১নং ইউনিয়ন। এককালে এই ইউনিয়নটি ছিল মেঘনা হতে বহুদুরে। কালকিনি আর মেঘনার মাঝে ছিলো অসংখ্য গ্রাম। সবগুলোই গেছে মেঘনার পেটে। সাথে নিয়ে গেছে মানুষের বাপ-দাদার বসতভিটা, ছোট্ট উঠান, চঁড়ুইভাতি খেলার জায়গা, লাজুক বালিকার পুতুল, দুষ্ট ছেলের লাটিম আর লাটাই, জ্ঞান চর্চার শিক্ষালয়, মসজিদ, মন্দির, চেনা-অচেনা নাম না জানা আরও অনেক অনেক কিছু। সবকিছু খেয়ে ক্ষুধার্ত মেঘনা এখন হাজির চর কালকিনির সামনে। অসহায় ছোট্ট গ্রামটি আতঙ্কে কাঁপছে যে কোন মুহুর্তে মেঘনায় হারিয়ে যাওয়ার।

সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু, দির্ঘ সাত বছর ধরে যিনি কাজ করছেন বাংলাদেশের উপকূল নিয়ে। তিনি জানান, “চর কালকিনি আগে অনেক বড় ছিল। মেঘনার ক্রমাগত ছোবলে ভেঙ্গে যাওয়ায় আগের থেকে অনেক ছোট হয়ে গেছে।” কালকিনিতে বর্তমানে একটি প্রাথমিক ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ ও তিনটি বাজার রয়েছে। ইউনিয়নটিতে যাতায়াতের প্রধান যে সড়কটি সেটি যুক্ত হয়েছে কাঠ আর গাছের গুঁড়ি দিয়ে জোড়াতালি দেয়া একটি সেতু দিয়ে। আগে এখানে সিমেন্টের তৈরী একটি সেতু ছিলো। কালকিনি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ সায়েফউল্লাহ্‌ জানিয়েছেন, “মেঘনার প্রবল জোয়ারে সেতুটি ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে কাঠ দিয়ে সেতুর ভাঙ্গা অংশটি জোড়া দেয়”।

দির্ঘদিন যাবৎ সেতুটি জোড়াতালি দিয়েই চলছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সেতুটি মেরামতের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে সেতুটি পারাপারে জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে লোকজনকে। সেতুটি দিয়ে লেগুনা, সিএনজি, ট্রাক্টর, অটোরিকশা এমনকি রিকশা-বাইসাইকেল চলাচলও বন্ধ রয়েছে। লোকজনকে মালামাল নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় মাথায় করে। রিকশা, অটোরিকশা আর সিএনজির মতো যানবাহনের চালকদের প্রতিদিনই দুরে অন্য কোথাও গাড়ি রেখে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।

কথা হচ্ছিলো সিএনজি চালক মো. শাহ আলমের সাথে। তিনি জানান, “সেতুটি ভেঙ্গে যাওয়ায় যাত্রীরা যানবাহনে চড়ে গন্তব্যে যেতে পারছেন না। ইউনিয়নের ভেতরের দিকে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। এটা শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের জন্যে খুবই কষ্টকর”। একই কথা বলছিলেন গিয়াস উদ্দিন, মহিন উদ্দিনসহ আরো বেশ কয়েকজন সিএনজি চালক।

স্থানীয় বাসিন্দা আকবর হোসেনকে নিজের মটর সাইকেল থাকা সত্ত্বেও অনেক দুরের পথ ঘুরে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে সেতুটি ভাঙ্গা থাকার কারনে । ফলে প্রতিদিনই সময়ের অপচয় হচ্ছে তার। চর কালকিনি কে. আলম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাওলানা আব্দুল মতিন জানালেন, “সেতুটি বিধ্বস্ত হওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসছেনা ছোট শিশুরা”। দির্ঘদিন ধরে ভাঙ্গা অবস্থায় পরে থাকায় এলাকায় এখন সেতুটির পরিচিতি “ভাঙ্গা পোল” নামে। স্থানীয়দের আঞ্চলিক উচ্চারনে “ভাঙ্গা পোল” হয়ে গেছে “ভাঙ্গা হোল”।

১নং চর কালকিনির অনেকটাই বিলীন হয়েছে মেঘনার বুকে। বাকিটা বিলীন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমতাবস্থায় ইউনিয়নটির ভাঙ্গা সেতু মেরামত করা কতটা যৌক্তিক হবে? বিষয়টি জানতে চেয়েছিলাম উপকূল নিয়ে কাজ করা মি. মন্টুর কাছে।

“অবশ্যই যৌক্তিক হবে” বললেন তিনি। “মেঘনার এই ভাঙ্গন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে তহবিল বরাদ্দ হয়েছে গত বছরেই। একটা ইউনিয়ন তো একবারে ভাঙ্গে না, একটা ইউনিয়ন পুরোটা ভাঙ্গতে সময় লাগে। সরকারের বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে গত বছরেই যদি ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু হতো তাহলে এখন ইউনিয়নটি যতটুকু আছে তার থেকে অনেক বড় থাকতো। কিন্তু ভাঙ্গন রোধে এখনও কোন কাজ শুরু না হওয়ায় ইউনিয়নটি আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে তা বলা মুশকিল” বললেন মি. মন্টু, নিখাঁদ ক্ষোভ ঝরলো তার কণ্ঠে।

চর কালকিনি ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, “বাজেট আসলে সেতুটির সংস্কার করা হবে”। কালকিনিবাসী জানেনা কখন সেই কাঙ্খিত বাজেট আসবে কিংবা আদৌ আসবে কিনা। নাকি ইতোমধ্যেই বাজেট এসে নিরবে ঢুকে গেছে কারো পকেটে তাও জানেনা অর্ধেক ভেঙ্গে যাওয়া এই ছোট্ট গ্রামের মানুষেরা।

কখনো কোনকালে সেতু তৈরীর বাজেট যদি আসেও প্রশ্ন হচ্ছে, ততদিনে চর কালকিনি মেঘনার পাড়ে টিকে থাকবে তো?

সর্বশেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৭, ১৫:৫৮
জুনাইদ আল হাবিব
কমলনগর প্রতিনিধি

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন