দুর্নীতি তদন্তে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে মোটা টাকার বিনিময়ে অভিযোগকারী ও দুর্নীতির বিষয়ে স্বাক্ষ্য প্রদানকারীদের বক্তব্য তদন্ত প্রতিবেদনে উল্টো করে উপস্থাপন করার অভিযোগ উঠেছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তবে তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবী করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান সিনিয়র উপজেলা মৎস কর্মকর্তা ইসমত আরা।

অভিভাবক ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে পীরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। বিদ্যালয়ের দোকান ঘর ও অন্যান্য খাত থেকে আয়ের বেশীর ভাগের সঠিক কোন হিসাব নেই। রশিদ ছাড়াই আদায় করা হচ্ছে টাকা। তবে যেসব খাতের টাকা একান্তই রশিদ ছাড়া আদায় না করলেই নয় শুধু সেসব ক্ষেত্রেই রশিদ ব্যবহার করা হয়। আদায় করা লক্ষ লক্ষ টাকা বিদ্যালয় উন্নয়নের নামে লুটপাট করা হচ্ছে। প্রতি বছর ভর্তি ফি, সেশন চার্জ, বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য ফি ছাড়াও সরকারী ভাবে সরবরাহ করা বিনামূল্যে বোর্ড বই বিতরণের ক্ষেত্রেও কৌশলে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি টাকা। টাকা না দিলে সরকারী বোর্ড বই সরবরাহ করা হয় না। টাকা দিতে না পারায় চলতি বছরের শুরুর দিকে অনেক শিক্ষার্থীকে সরকারী বই সরবরাহ করা হয়নি। দেরিতে হলেও টাকা নিয়েই বোর্ড বই সরবরাহ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি।

লিখিত অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন হলেন তোবারক আলী। চলতি শিক্ষা বছরে তিনি দুই হাজার কুড়ি টাকা জমা দিয়ে তার কন্যাকে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করান। ভর্তির পর তার কন্যা সরকারি বিনামূল্যে বোর্ড বই নিতে গেলে আরো তিনশত কুড়ি টাকা লাগবে বলে তাকে জানানো হয়। টাকা দিতে না পারায় তার কন্যার ভাগ্যে সরকারী বই জোটেনি। এ নিয়ে প্রধান শিক্ষক মফিজুল হকের শরণাপন্ন হলে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাকে। অসহায় তোবারক আলী কোন সুরাহা না পেয়ে ১১/০১/২০১৭ ইং তারিখে এর বিচার চেয়ে পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেন। এতে কোন কাজ না হলে পরবর্তীতে গত ০৪/০৬/২০১৭ইং তারিখে জেলা প্রশাসক ঠাকুরগাঁও বরাবরে অভিযোগ করেন। অভিযোগ পত্রের অনুলিপি শিক্ষা মন্ত্রী, শিক্ষা সচিব, চেয়ারম্যান, দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ড, চেয়ারম্যান দূর্নীতি দমন কমিশন বরাবরে প্রেরণ করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকেও কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

অবশেষে দীর্ঘ দিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়- উপজেলা প্রশাসনকে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রেরণের নির্দেশ দিলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার গত ১৭ আগষ্ট ০৫.৫৫.৯৪৮২.০০৩.০১.০০১.১৬-৭৬৫ নম্বর স্মারক মোতাবেক সরেজমিনে তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইসমত আরা কে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, উপজেলা একাডেমিক সুপার ভাইজার জহিরুল ইসলাম ও সহকারি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সাঈদা শাহনাজ। তদন্ত কমিটির প্রধান সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পত্র দিয়ে কমিটির অন্য সদস্যদের উপস্থিতিতে গত ২৭ ও ২৮ আগষ্ট অভিযোগকারী তোবারক আলী ও উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী (ছাত্র অভিভাবক) সহ আরো বেশ কয়েক জন অভিভাবক ও ভুক্তভোগীর অভিযোগের স্বপক্ষে লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেন।

অভিযোগকারীরা আরো জানান, এর আগে প্রধান শিক্ষক ও তার লোকজন তদন্ত কমিটির কাছে স্বাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য তোবারক আলীর সাথে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়ে তাকে বিভিন্ন প্রকার ভয়ভীতি দেখান। তার পরেও তোবারক আলী ও অন্যরা লিখিত বক্তব্য দেওয়ায় টনক নড়ে প্রধান শিক্ষক মফিজুল হকের। তিনি বিষয়টি ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও তদন্ত কমিটিকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। দাপট দেখাচ্ছেন সরকারী দলের নেতা বলে। খরচও করেন কয়েক লাখ টাকা। এদিকে অভিযোগকারী তোবারক সহ সংশ্লিষ্টরা তদন্তের ফলাফল জানার জন্য তদন্ত কমিটির প্রধানের কার্যালয়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করেন। কমিটির প্রধান তাদের জানান, চিন্তার কোন কারণ নেই। শক্ত ভাবেই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে। কয়েক দিন সময় লাগবে।

এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকারের বদলির আদেশ হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি নিয়ে পাবনায় চলে যান তিনি। এরপরও তদন্ত কমিটির প্রধানের কাছে তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারীদের জানানো হয় আরো সময় লাগবে। সময় লাগবে, সময় লাগবে- বলে অভিযোগকারীদের ঘুরাতে থাকেন তদন্ত কমিটির প্রধান। পরে অভিযোকারীরা খোজ নিয়ে জানতে পারেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বদলি হয়ে যাওয়া আগ মুহুর্তে অতি গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে অভিযোগকারীদেরে বক্তব্য আমলে না নিয়ে তদন্ত কমিটিকে দিয়ে প্রধান শিক্ষকের পক্ষে প্রতিবেদন নিয়ে উর্দ্ধগামী করেছেন।

সূত্র জানায়, গত ১২ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের শেষ কর্মদিবস হলেও তিনি বদলি নিয়ে পাবনার উদ্দেশ্যে পীরগঞ্জ ছাড়েন ১৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে। সেদিন বাড়ির সব মালামাল গাড়ীতে তুলে নির্বাহী অফিসারের বাস ভবনের সামনে থেকে রওনা হওয়ার আগ মুহুর্তে ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ এবং ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে তা উর্দ্ধগামী করার পত্রে স্বাক্ষর করে গাড়িতে উঠে পাবনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন নির্বাহী অফিসার এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। বিষয়টি গোপন রাখা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে তদন্ত প্রতিবেদন চাইলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানানো হয়-এটা দেওয়া যাবে না। পরে বাধ্য হয়েই প্রতিবেদন সহ সংশ্লিষ্ট তথ্য পেতে তথ্য আধিকার আইনে আবেদন করেছেন স্বাক্ষ্য প্রদানকারীদের মধ্যে একজন। এক্ষেত্রেও তথ্য দিতে টালবাহনা করা হচ্ছে। অভিযোগকারীরা বলেন,‘তদন্তের নামে তদন্ত কমিটি নাটকীয় ভাবে প্রধান শিক্ষকের পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছেন যা আমরা বিশ্বস্ত সুত্রে জানতে পেরেছি। দুর্নীতির তদন্তে দুর্নীতি হয়েছে।’

তদন্ত বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মফিজূল হক বলেন, তদন্ত কমিটি কি প্রতিবেদন দিয়েছে- আমি জানি না। এ বিষয়ে আমি কোন টাকা খরচ করিনি। কাউকে প্রভাবিত করার বা সরকারী দলের নেতা বলে কোন দাপটও দেখাইনি। তদন্ত কমিটির প্রধান সিনিয়র উপজেলা মৎস কর্মকর্তা ইসমত আরা বলেন, ‘তদন্তে কোন অনিয়ম করা হয়নি। স্বাক্ষ্য প্রদানকারীদের বক্তব্যের আলোকেই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়।’

বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকারের কাছে এ বিষয়ে মুঠো ফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যাক ডেটে নয়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরই যথা নিয়মে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ঠিক নয়।’

সর্বশেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:৪৫
আমিনুর রহমান হৃদয়
ফিচার প্রতিবেদক

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন