কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যতীত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ধারণাটি উপমহাদেশে সম্ভবত প্রথম আসে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে ভারতে ১৪টি বড় বেসরকারি ব্যাংককে সরকারের অধিগ্রহণের মাধ্যমে। এ ব্যাংকগুলোতে দেশের মোট জামানতের ৮৫ শতাংশ ছিল। সম্ভবত তখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জনপ্রিয়তার প্রেক্ষাপটে এই কার্যক্রম নেওয়া হয়। আর আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়ে সমাজতন্ত্র সুস্পষ্টভাবে জাতীয় চার নীতির একটি বলে ঘোষিত হয়। স্বাধীনতার পরপরই তার ছাপ পড়ে ব্যাংক, বিমা, বৃহৎ শিল্পসহ অনেক খাতে। এমনি অবস্থায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকস (ন্যাশনালাইজেশন) অর্ডার নামে রাষ্ট্রপতির একটি আদেশে সে সময়কার চালু সব কটি ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে আনা হয়। এরপর ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। চলেছে অনেক ভাঙাগড়ার খেলা। তবে রূপালী ব্যাংকের কিছু শেয়ার বেসরকারি খাতে ছাড়া বাদে শ্রেণিচরিত্র একই আছে। সোনালী, জনতা, অগ্রণীকে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হলেও শতভাগ শেয়ার রয়েছে সরকারি মালিকানায়। জমিজমাসহ অঢেল সম্পদের মালিক ব্যাংকগুলো। আমানতকারীদের আস্থাও আছে। কিন্তু মূলত থেকে যাচ্ছে লোকসানি ব্যাংকের কাতারে। আর তা এক-দুবার নয়। বারবার। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন সময়ে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। আবার তলা ফুটো বলে থাকে না কিছুই।
এ অবস্থার প্রধান কারণ খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতি। আর এ ঋণের অনেকাংশ খেলাপি হয়েছে গ্রাহকদের মানসিকতায়। তাঁরা ধরে নিয়েছেন, এগুলো দিতে হবে না। প্রকৃতপক্ষে অনেকে না দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন। এর কারণ মূলত ব্যাংক কর্মকর্তাদের একটি অংশের সহযোগিতা। এই খেলাপি গ্রাহকেরা প্রায় সব সরকারের সময়েই কোনো না কোনোভাবে একটি মহলের জোর সমর্থন পান। তাঁরা ঘটনার আড়ালে থেকেও দেন মদদ। ভোগ করেন সুবিধা। থাকে না কোনো দায়বদ্ধতা। আইন-আদালতের রাস্তাও বন্ধুর। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ব্যাংক আইনজীবীদের কেউ কেউ হয়ে যান খেলাপি গ্রাহকের শুভাকাঙ্ক্ষী। ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে রাখা সম্পত্তি অতিমূল্যায়ন করা হয় প্রায় ক্ষেত্রে। তাই কালে-ভদ্রে দু-একটি মামলায় জিতলেও পাওয়া যায় খুব কম দাম। বাংলাদেশ ব্যাংকেও ঘাপটি মেরে আছেন অনিয়ম ও জালিয়াতির সহযোগীরা। তাই হল-মার্কের মতো ঘটনা ঘটে। হুইসেল বাজানো হয় চোর পালানোর পর।
কথা হতে পারে এসব ক্ষেত্রে সরকার কী করল? আমরা যদি পেছনে তাকাই তাহলে দেখব স্বাধীনতার পরপর রাষ্ট্রমালিকানাধীন শিল্পগুলোও ভালো চলছিল না। শ্রমিকদের বেতন হতো না। অনেক ক্ষেত্রে সেসব সমস্যায় হুকুম হতো রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে ধার দিতে। আর বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিশোধ হতো না সুদ বা আসল কিছুই। শ্রমিক তাঁর ন্যায্য পাওনা পাবেন। রাষ্ট্রমালিকানাধীন শিল্প বিধায় এর দায় সরকারের। সরকারের উচিত ছিল বাজেট থেকে সেই টাকা ব্যাংকগুলোকে দিয়ে দেওয়া। দেওয়া হয়নি। হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া ব্যাংকঋণ নিয়ে আদমজী পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের ঋণে শ্রমিকদের পাওনা গন্ডা মেটানো হয়েছে। শোধ হয়নি ব্যাংকঋণ। কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের মিলের সে জমি প্রতীকী মূল্যে দেওয়া হয় বেপজাকে। পঁচাত্তরের পর চালু হয় বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক। আরও একবার সামরিক শাসন আসে। এ উভয় সামরিক শাসনের সময়ে তাদের ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করতে গড়ে তোলা হয় রাজনৈতিক দল। দলে লোক ভেড়াতে অনেককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে দেওয়া হয় ঋণ। এসব ঋণের বড় অংশ খেলাপি হয়েছে। শিল্প-ব্যবসা ব্যতীত স্থানান্তরিত হয়েছে অন্য খাতে। গড়ে উঠেছে একটি নব্য ধনিক শ্রেণি। তাঁদের কেউ কেউ হয়েছেন বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক। এখন সরকারি ব্যাংকের অব্যবস্থাপনাকে কষে সমালোচনা করেন।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে সরকারের হুকুমে লাভ-লোকসান বিবেচনা না করে বিভিন্ন স্থানে অগুনতি শাখা খুলতে হয়েছে। চালু করতে হয়েছে ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব। কৃষকের স্বার্থে এ ধরনের ব্যাংক হিসাব অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সরকারি সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক। তবে এ কাজ করতে লোকবলসহ ব্যাংকের কত খরচ হয়, এটা কি দেখা হয়েছে? এ ঘাটতিটা তো সরকারের ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংকগুলোকে দিয়ে দেওয়া উচিত। আর যদি ধরা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মালিক রাষ্ট্র। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সরকার যেভাবে বলবে, সেভাবেই তারা খরচ করতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে তো এসব ব্যাংকের লাভ-লোকসান হিসাব করার প্রশ্ন আসে না। সরকারের দপ্তরের মতোই চলতে পারে। সরকারের বহু ধরনের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এ ব্যাংকগুলো। প্রধানত সোনালী ব্যাংক। এ সেবার গুটি কয়েকের জন্য নামমাত্র কমিশন দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই বিনা মূল্যে। দীর্ঘকাল জ্বালানি তেল ভর্তুকিতে বিক্রি করেছে সরকার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ক্ষেত্রবিশেষে এলসির পুরো টাকাও জোগাড় করতে পারত না। আগের বকেয়া তো থাকতই। এভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে বকেয়া পড়ে থাকে বিপিসির নামে। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শতকরা ৫ ভাগ সুদে তিন বছর মেয়াদি বন্ডের মাধ্যমে এ দেনা পরিশোধ করা হয়।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর ধারণা করা হয়েছিল ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আসবে। কিন্তু তা আসেনি; বরং দিন দিন খারাপ দিকেই যাচ্ছে। একটি নব্য ধনিক শ্রেণি সব সময় সরকারের প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ শ্রেণিটি রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাতেই থাকে। তবে তা বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে অনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নয়। কয়েকটি মাত্র শিল্পগোষ্ঠীর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণ। আর তা নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না দীর্ঘকাল। প্রায়ই হয়ে পড়ে খেলাপি। আর এ থেকে উত্তরণে তাদের জন্য থাকে বিশেষ প্যাকেজ। মাত্র কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ অনেক দীর্ঘ মেয়াদে, কিস্তির পরিমাণ হ্রাস ইত্যাদি করে রিস্ট্রাকচার করা হয়। এটা এ দেশের ব্যাংকিং জগতে অভিনব। জানা যায়, এ কিস্তিও তারা স্বভাবগতভাবেই নিয়মিত দিচ্ছে না। সরকারের প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এমনটি ঘটতে পারত না। বেসিক ব্যাংক নামের ব্যাংকটির মূল লোপাটকারীদের (অর্থমন্ত্রী সংসদে প্রধানত যাঁদের নাম বলেন) ধারেকাছে ভিড়তে পারছে না দুদক।
১৯৭৫-এর পরিবর্তনের পর থেকে আসতে থাকে বেসরকারি ব্যাংক। এরপর কিছু ক্রান্তিকাল ছাড়া যে সরকারই আসে তারা তাদের অনুগ্রহভাজন ব্যক্তিদের দেয় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স। দেয় অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে সরকারের। এমনকি কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সুস্পষ্ট নেতিবাচক অবস্থান নিলেও তা পরিবর্তনে বাধ্য হয়ে দিয়েছে নতুন লাইসেন্স। একই অবস্থা নন–ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনের (এনবিএফআই)। বাজারের চাহিদার কথা বিন্দুমাত্র বিবেচনায় না নিয়ে আসে নতুন নতুন ব্যাংক ও এনবিএফআই। ফলে টাকা লগ্নির বাজারে শুরু হয়েছে এক অশুভ প্রতিযোগিতা। এর সুযোগ নিচ্ছেন একশ্রেণির গ্রাহক। উপযুক্ত জামানত দিতে চাইছেন না অনেকে। ফলে খেলাপি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে অনেক ব্যাংক; বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলো। ব্যাংক ও এনবিএফআই যে হারে বেড়েছে, সে অনুপাতে বাড়েনি দক্ষ জনশক্তি। এ সুযোগে মোটা অঙ্কের মাইনে হাঁকছেন অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাতে সরকার নিয়োজিত ব্যক্তিরাই পরিচালনা বোর্ডে থাকেন। সে বোর্ডে কিছু অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তি থাকলেও অনেকেই শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত। নীতিনির্ধারণ এবং বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করে বোর্ড। যাঁরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন, তাঁদের ঋণপ্রস্তাব যথাযথ বিশ্লেষণ ছাড়াই পাস হয়ে যায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও। তাঁরাই পথ বাতলে দেন কাকে দিয়ে এমডি বা চেয়ারম্যানকে ফোন করালে বোর্ডে আটকাবে না। আর এসব ফোন যাঁরা করেন, তাঁরা নিছক দলীয় বিবেচনায় নেতা-কর্মীর জন্য করছেন, এমন নয়। আর খেলার কৌশলটি অভিনবও নয়। বেশ কিছুকাল ধরে চলে আসছে এ অবস্থা। ব্যাংকের এসব অসাধু কর্মকর্তাও ফুলে–ফেঁপে উঠছেন অনুপার্জিত আয়ে। এ সর্বনাশা পথ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ফেরানোর কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। উল্লেখ্য, সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে পথ রোধ না করলে ক্ষয় বাড়তেই থাকবে। এ রাজনৈতিক অঙ্গীকার কিন্তু আমরা কোনো সরকারের সময়েই পাচ্ছি না।
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
পাঠকের মন্তব্য