মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নতুন করে সহিংসতা এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পাশাপাশিই সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, সেখানে অজস্র বিভ্রান্তি-সৃষ্টিকারী ছবি বেরুতে শুরু করেছে ।
বিবিসির সংবাদদাতা জোনাথন হেড লিখছেন, এসব ছবির বিষয়বস্তু অত্যন্ত নৃশংস এবং উস্কানিমূলক, এবং এগুলোর বেশির ভাগই ভুয়া।
রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধদের সাথে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংঘাত বহুবার মারাত্মক দাঙ্গার চেহারা নিয়েছে। কিন্তু এসব এলাকায় সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত সীমিত, আর ঘটনা সম্পর্কে তথ্যও পাওয়া যায় খুবই কম।
যারা সেখানে যেতে পেরেছেন, তারাও দেখেছেন যে পরিস্থিতি এবং দুই সম্প্রদায়ের বৈরিতার কারণে তথ্য সংগ্রহ করাও খুব কঠিন।
সম্প্রতি যা ঘটেছে তা হলো এই রকম: গত সপ্তাহে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামে একটি জঙ্গী গ্রুপ কমপক্ষে ২৫টি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে। অন্য কিছু এলাকাতেও সংঘর্ষ হয়, কোথাও কোথাও রোহিঙ্গা গ্রামবাসীরাও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জঙ্গীদের সাথে যোগ দেয়। অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়, তাদের ওপর গুলি চালায়। কোথাও কোথাও বৌদ্ধ বেসামরিক লোকেরা নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতা করে। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীও আক্রান্ত হয়েছে, কেউ কেউ নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের সবশেষ হিসেবে প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মুখে শোনা গেছে মর্মান্তিক নির্যাতনের গল্প।
২৯শে আগস্ট তুরস্কের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মেহমেত সিমসেক চারটি ছবি টুইট করেন, রাখাইন প্রদেশে জাতিশোধন থামানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তার এ ছবিগুলো রি-টুইট করা হয় ১ হাজার ৬শ বার, ‘লাইক’ দেন ১ হাজার ২শ জন।
কিন্তু খুব দ্রুতই এ ছবিগুলোর যথার্খতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অনেক লোক এ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করায় তিন দিন পর মি. সিমসেক ছবিগুলো মুছে দেন।
প্রথম ছবিটিকে অনেকগুলো ফুলে-ওঠা মৃতদেহ দেখা যায়। বেশ কিছু বার্মিজ - যারা মি. সিমসেককে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন - তারা বলেন, এগুলো ২০০৮ সালে সাইক্লোন নার্গিসে নিহতদের ছবি। অন্য অনেকে বলেন, এটা এক নৌকাডুবিতে নিহতদের ছবি। তবে ওই ঘটনাগুলোর এমন কোন ছবি পাওয়া যায় নি - যা হুবহু এ রকম। তবে এ ছবিগুলো কিছু ওয়েবসাইটে বেরিয়েছিল - কিন্তু তা গত বছর । এর মানে, ছবিগুলো রাখাইন রাজ্যে গত কয়েকদিনের সহিংসতার ছবি নয়।
দ্বিতীয় ছবিটি গাছের সাথে বাঁধা একজন মৃত পুরুষের জন্য বিলাপরত এক নারীর। বিবিসি নিশ্চিত করেছে যে এটি ২০০৩ সালের জুন মাসে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে তোলা, আর তা তুলেছেন রয়টারের একজন ফটোগ্রাফার।
তৃতীয় ছবিটি মায়ের মৃতদেহ নিয়ে ক্রন্দনরত দুটি শিশুর। এটি তোলা হয়েছে রোয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ে। ওয়ার্ল্ড প্রেস এওয়ার্ড পুরস্কার প্রাপ্ত একটি সিরিজের অংশ এই ছবিটি তুলেছিলেন সিপা’র আলবার্ট ফাসেলি।
চতুর্থ ছবিটি একটি নালায় ডুবে থাকা কিছু লোকের। এ ছবিটির উৎস বের করা কঠিন ছিল। কিন্তু নেপালের সাম্প্রতিক বন্যার জন্য সাহায্যসংগ্রহকারী একটি ওয়েবসাইটে এই ছবিটি আছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দু’পক্ষ থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবির যুদ্ধ চালানো হচ্ছে।
বিবিসির জোনাথন হেড বলছেন, তিনি নিজে এরকম বহু ছবি পেয়েছেন, যাতে গণহত্যার শিকারদের বীভৎস চিত্র রয়েছে। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগের যথার্থতা প্রমাণ করা কঠিন।
তবে কিছু ছবি আছে - যা স্পষ্টতই ভুয়া।
এরকম একটি হচ্ছে: কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গীদের রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং নেবার দৃশ্য।
কিন্তু আসলে এটি হচ্ছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লংঘন নিয়ে এক গবেষণা করে। এতে গবেষকরা তাদের নিজেদের তোলা ছবি বা ভিডিও ছাড়া আর কোনকিছু ব্যবহার করেন নি, যার কারণ ছিল ছবিগুলোর সত্যতা নির্ণয়ের সমস্যা।
তবে তাদের রিপোর্টে তার রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর ‘ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার’ যে তথ্য উঠে আসে - তা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে আখ্যায়িত হতে পারে’ বলে উল্লেখ করা হয়।
আমরা যেসব তথ্য পাচ্ছি, তাতে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় যে রাখাইন প্রদেশে গুরুতর সংঘাত চলছে, এবং বড় সংখ্যায় মানুষ হতাহত হচ্ছে।
কিন্তু এ সংকট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিভ্রান্তিকর প্রচারাভিযান চলছে - তাতে দু’পক্ষের বৈরিতা আরো বাড়বে, এবং হয়তো এই সংঘাতও আরো খারাপ মোড় নেবে।
পাঠকের মন্তব্য