ধর্ষণের মহোৎসব চলছে: প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা জরুরী

পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের খবর নেই এমন দিন হয়তবা খুব কমই যাচ্ছে । ধর্ষণ হচ্ছে, মামলা হচ্ছে, পুলিশ গ্রেফতার করছে,আদালত বিচার করছে তবুও যেন কিছুতেই থামছেনা বা কমছেনা ধর্ষণ । আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দিন দিন শিক্ষিত ও উন্নত হচ্ছে । কিন্তু আমাদের মানুষিকতার কি কোন পরিবর্তন হচ্ছে??? আজ আমাদের সমাজ কলংকিত, ধর্ষণ নামক এ ভয়াল থাবায় । আজ যে বিষয়টি আমাকে বেশি নাড়া দিয়েছে সেটি হলো,বাবা মেয়েকে দুই বৎসর যাবৎ ধর্ষণ করছে । ঘটনাটি টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর উপজেলার ফুলমালিরচালা গ্রামে । মেয়ে এ নির্যাতন আর সহ্য করতে না পেরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ধারে গিয়েও কোন প্রতিকার না পেয়ে,সাগরদিঘী পুলিশী তদন্ত কেন্দ্রে অভিযোগ দাখিল করেছে । সমাজে ধর্ষক আজ বেপরোয়া । প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই আমাদের পড়তে হয় কোন না কোন ধর্ষণের খবর । পত্রিকার প্রথম পাতা কিংবা শেষ পাতায় ছাপা হয় ধর্ষণ । ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না দ্বিতীয়ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েরাও । আজ যখন এ বিষয় নিয়ে লেখা হচ্ছে তখন ও বিশ্বের কোন প্রান্তে ধর্ষণের ঘটনা গঠছেই । ভুক্তভোগী এবং ভুক্তভোগীর পরিবার কখনো লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনা প্রকাশ করে না বা ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না । আমার দেশের প্রতিটি নারী নিরাপদে ঘরে যেতে পারলে তবেই আমি ঘুমাতে পারি।এ ঘুম তো ঘুম নয় যদি গভীর রাত্রে অনলাইন জার্নাল এ দেখতে হয় একা পেয়ে কোন নারীকে ছোবল মেরেছে কোন মানুষ নামধারী হিংস্র জানোয়ার। এটা তো শান্তির ঘুম হতে পারে না।একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এই বিষয়গুলো কখনো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না।এগুলো স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার মতো ঘটনা ও না।আমি এই ধর্ষক ভরা সমাজ দেখতে চাই নি!এ সমাজে এত ধর্ষক কিভাবে খেয়ে দেয়ে সুস্থভাবে মানুষের মত চলাফেরা করছে তা আমার বোধগম্য হয় না।একটা সভ্য সমাজের কীটপতঙ্গ হলো ধর্ষক। মানুষ নামধারী কিছু অসভ্য জানোয়ার হলো ধর্ষক। মানুষের মত কথাবার্তা বলতে পারা আর মানুষের মত ব্যবহার করতে পারা কিছু বিকৃত মস্তিষ্কজাত পশুর নাম ধর্ষক।

যেকোন নারীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সাথে জোরপূর্বক মিলিত হওয়াকে ধর্ষণ বলে।ধর্ষণ যেকোনো সমাজ ব্যবস্থার জন্য কতটা হুমকিস্বরুপ তা অনুধাবন করলে বুঝা যায়।একজন পুরুষ যদি নিরাপদে যেকোন সময় ঘরে ফিরতে পারে তবে কেন একজন নারী নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে না।এটা তো নারীর অধিকার। বেচে থাকার জন্য একজন নারীর সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলো তার নিরাপত্তা।আমি যখন এই লিখাটা লিখছি তখন ও আমাদের দেশসহ ও সারা বিশ্বে কয়েকশত ধর্ষণ এর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।এটা নারী জাতির জন্য কতটা হুমকিস্বরুপ আর অবমাননাকর তা একজন নারী ছাড়া কোন পুরুষ অনুধাবন করা সম্ভব না।

আমরা শুধু ধর্ষিতা নারীর বাইরের কান্না দেখি তার মনের ভিতর কিসব যন্ত্রণা তখন আঁকিবুঁকি করছে সেটা একমাত্র নারী ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারে না। কত শত শত নারী অঝোরেই চলে যায় তার ভিতরের কান্নাগুলো কাউকে বলতে পারে না বলে।কত শত শত নারী না বলেই ঝাপ দেয় অজানা কোন জগতে শুধু তার সাথে ঘটে যাওয়া বীভৎস ঘটনাগুলো কাউকে বলতে পারে না বলে।আমরা তো এ সমাজ ব্যবস্থা চাই নি। আমরা চাই নারী পুরুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে এক সুন্দর ধরণী।যেখানে আমার কোন মা বোন কোন হিংস্র জানোয়ারের থাবায় জীবন বিলিয়ে দিতে হবে না। শান্তিতেই বাস করবে এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা চাই।

ধর্ষণ এর বর্ণনা দিতে গিয়ে মনে হল আমাদের দেশে শুধু যে ধর্ষণ ঘটে এমন তো না। ধর্ষণ এর চেয়ে ভয়ানক গণধর্ষণ হচ্ছে আজকাল।এইতো মাত্র দু চার দিন আগের কথা রাজশাহীতে দেখলাম এক মেয়েকে এক বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেছে কিছু মস্তিষ্কবিকৃত মানুষ। বন্ধু ভেবে বিশ্বাস করে শহরে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করেছিলেন এটা তো কোন অপরাধ না। এভাবে কাউকে বিশ্বাস করে দেখা করতে গেলে যদি কোন নারী ধর্ষণ হয়ে যায় তবে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করা বাদ দিয়ে দিবে। একজন নারী আমাদের কখনো বোন কখনো মা কখনো বন্ধু কখনো জীবন চলার জন্য চিরসাথী।কিন্তু এক নারীকেই যখন ধর্ষণ করা হয় তখন পুরো নারী জাতিকে অপমান করা হয়।দিনাজপুর এ দেখলাম এক নারীকে গণ ধর্ষণ করেছে কিছু পাষণ্ড। আবার মাঝেমধ্যে দেখা যায় রাস্তায় একা পেয়ে কোন নারীকে গণ ধর্ষণ করতে পিছুপা হয় না এই পাষণ্ড হিংস্র জানোয়ারগুলো।

এ সমাজে কেন আজ এতো ধর্ষণের জয়জয়কার। এ যেন এক নীরব উল্লাস। এ উল্লাস কোন দেশ বা জাতিকে মুক্ত করতে পারার নয়; এ উল্লাস কোন অবলা নারীকে ধর্ষণ করতে পারার জন্য। এ উল্লাস কোন বিজয় ছিনিয়ে আনে না। এ উল্লাস একটি সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য যতেষ্ট।এ উল্লাসে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় কোন অসহায় নারীর কান্না।এ উল্লাসে কান পাতলে শুনা যায় কোন নারীত্ব নিয়ে যুদ্ধ করা কোন নিরুপায় নারীর কান্না।এ উল্লাসে কান পাতলে শুনা যায় হাজারো ধর্ষিতার কান্নায় ভারি হয়ে যাচ্ছে আকাশ বাতাস।

এ উল্লাসে কান পাতলে শুনা যায় অন্ধকার জগত থেকে ফেরত আসা কত নারীর কান্না।এ উল্লাসে কান পাতলে শুনা যায় আই এস দ্বারা ধর্ষিতা নারীর কান্না।এ উল্লাসে কান পাতলে শুনা যায় যুদ্ধের নামে লাখো নারীর সতিত্ব ধ্বংস করার পায়তারা। এ উল্লাসে কান পাতলে নারীত্ব বুঝার আগে ধর্ষিতা হওয়া কত নিষ্পাপ শিশুর অজস্র আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায়।এ উল্লাস মানসজনমকে অসম্মান করার উল্লাস।এ উল্লাস মানুষ্য জাতিকে অপমান করার উল্লাস।এ উল্লাস নিজের ঘরে থাকা নারীকে অপমান করার উল্লাস। এ উল্লাস সমাজ অধঃপতন এর উল্লাস।এ উল্লাস বিকারতার চরম শিখরে চলে যাওয়া ঘুণে ধরা সমাজের প্রতিচ্ছবি।

মাত্র ১০ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশে বহু পার্থক্য বিদ্যমান। দেশ আজ নানা ক্ষেত্রে বিশাল উন্নতিসাধন করেছে।দেশ যেখানে পরিবর্তন হচ্ছে সেখানে কিছু মানুষের মন মেজাজে এখনো হিংস্রতা রয়ে গেছে।তারা আজ নারীদের উন্নয়নকে তাদের কাজের ক্ষেত্রে বাধা মনে করছে।একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণ এর জন্য একরকম কু মনোভাব আর উগ্র চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সমাজকে নতুবা দেশ নিয়ে আগাণো সম্ভব না।দেশ ও জাতির উন্নতির লক্ষে সবাইকে এক যোগে কাজ করা উচিত।সৃষ্ট্রির আধিলগ্ন থেকে যেখানে নারী পুরুষের বিচরণ সেখানে নারীর পথচলা রুদ্ধ করা হলে সমাজের অধঃপতন হবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমাজ হাজারো গুন পিছিয়ে পড়বে।একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এর জরিপ অনুসারে”২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ চিত্র থেকেই স্পষ্ট- প্রতিবছরই শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৬৮৬টি শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানীসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালে সারা দেশে ৭২৭টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তবে তাদের জরিপ অনুসারে ২০১৫ সাল থেকেই শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও নিপীড়ন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪তে সর্বমোট ২২৪টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল।

মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যলোচনা করে নারী ও শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনা সংরক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৬২ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৭৮ জন এবং ১৩ থেকে আঠারো বছর বয়সীর সংখ্যা ২৫১ জন। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রায় সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যাদের ২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ রকম বিভিন্ন সংস্থার হিসাবেও একথা স্পষ্ট যে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনার শিকার হওয়াদের অধিকাংশই শিশু।

২০১৬ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭২৪ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। আর ২০১৫ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৩৬টি। এর মধ্যে ২৩২ জন নারী ও চারজন পুরুষ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।নৈতিক শিক্ষার তথা নৈতিক মূল্যবোধ কমে যাওয়ায় অপরাধ প্রবনতা বেরেই চলেছে এছাড়াও অপরাধের শাস্তি বিধানে রাষ্টযন্ত্রের গরিমসী অথবা আইনের ফাকফোকরে অপরাধীর দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি না পাওয়া অন্যতম ।এইসব দুষ্টু ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে বিধ্বংসী একটি মধ্য যোগীয় শ্রেণী । আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়াজ তুলি এবং মূল্যবোধের অনুসাশন ফিরে আসবে ।

আমাদের ধর্ষণ রুখতে হবে। মানবসৃষ্ট এই মহামারী বিপদ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে মানবজাতির চরম অধ:পতন হবে।

সর্বশেষ আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৭, ০০:৩৮
এস.এম আবু সাঈদ
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন