লক্ষ্মীপুরে রাক্ষুসে মেঘনার তীব্র ভাঙ্গন; মানুষের হাহাকার

‘মেঘনা নয় যেন রাক্ষুসে হানা, একথা ছিলোনা আগে কমলনগর-রামগতির মানুষগুলোর জানা।’ লক্ষ্মীপুরে দীর্ঘ ধরে তীব্র ভাঙ্গনে মেঘনা গিলে খাচ্ছে দু’টি উপজেলা কমলনগর ও রামগতি। এর মধ্যে রামগতির অধিকাংশ ভূ-খন্ড ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নিঃশেষ। বাকি যে অংশটি টিকে আছে তার মধ্যে কিছু অংশ বেড়িবাঁধের ছোঁয়ায় আর কিছু অংশ বেড়িবাঁধহীন। বেড়িবাঁধহীন এলাকাটি তীব্র ভাঙ্গনে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা অসংখ্য কৃতি সন্তানের স্বপ্নের ভূ-খন্ডটি!

অন্যদিকেই একই উপজেলাটির পাশাপাশি কমলনগর উপজেলাটিতেও ক্ষুধার্ত মেঘনার তীব্র ভাঙ্গন ভয়াবহ! বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি- বেসরকারি স্থাপনা দীর্ঘ দিন ধরে বিলীন হচ্ছে এখানেও। এখনোও বহু সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, মানুষের ব্যক্তিগত স্বপ্ন রাক্ষুসে মেঘনার মারাত্মক হুমকিতে! উপকূলের এই প্রান্তিকের মানুষগুলো তিল তিল করে গড়ে তোলে বিশাল স্বপ্নের বুনিয়াদ। যা মেঘনা বুঝেও না বুঝার ভান করে মানুষের পাহাড়সম দীর্ঘ প্রতিক্ষার আশা তীব্র বেগে ছিনিয়ে নেয়।

এই পিছিয়ে পড়া জনপদের শিক্ষার্থী অনেকেই সৃজনশীল, শুধু মেঘনায় অনিয়ন্ত্রিত হানায়! কেউ লিখে কবিতা, কেউ গল্প-ছোট গল্প, কেউ ফিচার, কেউবা আবার লিখতে শিখেছে সংবাদ। কেউ সাহিত্যিক আর কেউ সংবাদকর্মী। কিন্তু লেখালেখি চলে, সবাই জানে মেঘনাপাড়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের

হাহাকার কেমন? শুধু আশ্বাস মিলে, বাস্তব প্রেক্ষাপটে দ্রুত কোন সমাধান মিলছে না। অবশ্য একটা প্রবাদ বাক্য আছে, “নদীর এ কূল ভাঙ্গে ঐ কূল গড়ে, এইতো নদীর খেলা, সকাল বেলা আমি পরে সন্ধ্যা বেলা।” ঠিক প্রবাদটির প্রতিফলন লক্ষ্মীপুরের ক্ষুধার্ত মেঘনার আক্রমণে কমলনগর-রামগতির
মানুষের বাস্তব জীবনে। ধনীর সহায়-সম্পদ হারিয়ে হয়ে পড়ে বাস্তচ্যূত আর গরীবরা হয়ে যায় আরো অসহায়!

উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, কমলনগর উপজেলার ২নং সাহেবেরহাট ইউনিয়ন যে পরিবারের নামে হয়েছে সেই ‘সাহেব পরিবারে’র কথা। পাঠকএবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এ পরিবারের ধন-সম্পদ কতখানি ছিলো? মেঘনার এই পরিবারের বাড়ি- ঘর বহু গিলেছে। পরিবারেও দেখা দিয়েছে এক বিরাট ভাঙ্গন, বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আজীবন আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকা স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার। সবাই এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের পরিবারের এক সদস্য ফজলে রাব্বি রবিন। পড়ালেখা এবার উপকূল ডিগ্রী কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে। সে জানায়, “মেঘনায় আমাদের অনেক কিছু বিলীন। মনযোগ দিয়ে পড়ালেখাটাও হলো না আমার। বারবার স্কুল বদল করেছি। পড়ালেখার মনযোগ অনেক সময় ভেঙ্গে যেতো। হঠাৎ পড়ালেখা ছিটকে পড়েছি। পরিবারের সদস্যদের সচেতনতায় এখনও পড়ালেখা চলছে”।

স্রষ্টার এই ইশারাই একূলের মানুষগুলোর কোন ঠাঁই মিলছেনা স্থায়ীভাবে। ভাঙ্গনে তাড়িয়ে ফেরা মানুষগুলো এখন সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণার দিকে তাকিয়ে আছেন। কখন মিলবে এর স্থায়ী সমাধান? সামনে বর্ষা আসছে, উত্তাল ঢেউয়ের তীব্র আঘাতে মেঘনা আবারও কূলের মানুষদের তাড়িয়েফেরাতে শুরু করেছে। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে মেঘনার তীব্র তান্ডাবের তথ্য। পরিদর্শনে তথ্য অনুসারে ২৫দিন আগে কমলনগরেরনাছিরগঞ্জ ১কিমি হাঁটা হয়েছে। এখন আবারও ঐ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানের প্রায় ৪০মিটারের মতো জায়গা মেঘনার গভীর তলদেশে।

জোয়ারে ভাঙ্গে উপরিভাগ, আর ভাটা ভাঙ্গে নিম্মভাগ! আর অল্প কয়কে দিন পরেই আসছে বর্ষাকাল। জোয়ারের পানি বেশি হবে, বেড়িবাঁধের অভাবে পানিগুলোতে ডুববে মানুষের ঘর-বাড়ি। আবার সেই পানি যখন ফিরবে নদীর কূল ঘেঁষে, তখন কূল বিধ্বস্ত হবে। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে আঘাত হানা
ঘূর্নিঝড় মোরা’র প্রভাবে জলোচ্ছাসেই তার প্রমাণ। হঠাৎ মেঘনার এই তীব্র রাক্ষুসে তান্ডবে আতংকে ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে দিশেহারা হয়ে ছুটাছুটি করেছেন মানুষজন! এখনও মেঘনা উত্তাল, ভাঙ্গছে মানুষের তিল তিল করে গড়া তোলা সম্পদ।
মেঘনার এই মরণ ফাঁদে মেঘনাপাড়ের ৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু ভেঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ আর কিছু প্রকল্প বরাদ্ধ আসলে প্রকৌশলীরা মেঘনার ভাঙ্গন দেখে উল্টো ভবন নির্মাণ না করার প্রতিবেদন দিয়ে দেন। এতে ঐসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরাঠাসাঠাসি করে পড়ালেখা করতে হচ্ছে। এতে পড়াশুনা পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকেই যায়। শিক্ষার্থী অনেক. ভবন সংকট, শিক্ষকও নেই। কিভাবে লেখাপড়ায় মনযোগী হবে পড়ুয়া? বহু আগেই ভাঙ্গন প্রতিরোধে বাজেট বরাদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর প্রতিফলন এখনও ধোঁয়ার মতো।

এদিকে কমলনগরে মেঘনার তীর রক্ষার জন্য বরাদ্ধকৃত এক কিলোমিটার কাজ নিম্মমানের উপকরণ দিয়ে করার অভিযোগ উঠেছে। কাজটি পায় নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। অর্থ বরাদ্দের দুই বছর পর প্রতিষ্ঠানটি ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংকে দিয়ে কাজ শুরু করে। কিন্তু কাজ শেষ না হতেই ধসে পড়েছে ব্লকে নির্মিত কমলনগরের মেঘনার তীর রক্ষা বাঁধ! ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মানুষজন অভিযোগ করে বলেন, “যথাযত ভাবে জিও ব্যাগ ও ইট-পাথরের ব্লক দিয়ে ডাম্পিং না করায় বাঁধের উত্তারাংশের বেহাল অবস্থার জন্য প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মেঘনার ভাঙ্গন থেকে কমলনগর রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়বে।” মানুষজন আরো দাবি করে বলেন, “রামগতিতে যেভাবে সেনাবাহিনী দ্বারা মেঘনার তীর রক্ষা বাঁধের কাজ করা হয়েছে ঠিক তেমনি কমলনগরে যেন আগামি মেঘনার ভাঙ্গন প্রতিরোধ প্রকল্পে বরাদ্ধকৃত কাজ সেনাবাহিনী দিয়ে করা হোক, নচেৎ কমলনগরও লক্ষ্মীপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।” কবে মিলবে সংকটের সমাধান? কবে মানুষ ফিরে পাবে তাদের অতীত অস্তিত্ব?
এমন প্রশ্নগুলোর দ্রুতই কার্যকরি সমাধান আশা করছেন বিশিষ্টজনেরা।

সর্বশেষ আপডেট: ৯ জুলাই ২০১৭, ২২:৩২
জুনাইদ আল হাবিব
কমলনগর প্রতিনিধি

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন