দিনটা গত বছরের ১ জুলাই, শুক্রবার। রোজা তখন শেষ হয়ে আসছে। চারদিকে ঈদের আমেজ। অফিসের কাজ চলছে কিছুটা হালকা মেজাজে। এর মধ্যেই রাত আটটার দিকে নানা সূত্রে খবর আসতে লাগল, গুলশানে কী একটা ঝামেলা হয়েছে। আর সেটা গুলশান ২ নম্বর এলাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে। সাড়ে আটটার দিকে অফিস থেকে রওনা হলাম। ইফতারের পরপর বলে সড়ক প্রায় ফাঁকা। বড় কোনো জটে পড়তে হলো না।
ঘটনাস্থলে গিয়ে জানলাম, কয়েকজন সশস্ত্র তরুণ হোলি আর্টিজানের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। সেখান থেকে কেউ বের হতে পারছেন না। দেখি, নিরাপত্তার জন্য রেস্তোরাঁটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। আশপাশেও প্রচুর পুলিশ। গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। অন্য সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আমি দূরে দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে!
আশপাশে রেস্তোরাঁয় আটকে পড়া মানুষের স্বজনদের ভিড়। তাঁদের চোখমুখে উদ্বেগ আর আতঙ্কের ছাপ। অনেকে কাঁদছেন। কী করতে হবে তার দিশা না পেয়ে অনেকে হতবিহ্বল। একবার তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন, আরেকবার ছুটছেন সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কাছে—যদি কিছু জানা যায়! সামান্য আলোর ইশারা পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁদের বিন্দুমাত্র ভরসা দেওয়ার মতো সামর্থ্যও তখন কারও নেই। পুরো পরিস্থিতিই অত্যন্ত গোলমেলে ও ঘোলাটে।
স্বজনেরা কেউ কেউ যে আমাদের অক্ষমতার বিষয়টি বুঝতে পারছেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁদের মন মানছে না। ব্যাকুল হয়ে তাঁরা জানতে চাইছেন, কেমন আছেন রেস্তোরাঁয় আটকে পড়া তাদের প্রিয়জনেরা? নানা কথা বলে আমরা তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো তথ্য দিতে পারলাম না। এমন একটা উড়ো খবর পাচ্ছিলাম, হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা হয়েছে। কিন্তু সে তথ্য নিশ্চিত করছেন না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে শুনতে পেলাম, পুলিশ অভিযান চালাবে। হোলি আর্টিজানের ভেতরে ঢুকবে। ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক, পুলিশের সঙ্গে হোলি আর্টিজানের দিকে যেতে হবে। আমি পুলিশের সঙ্গে মিশে গেলাম। আমার গেটআপ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না, আমি সাংবাদিক বা বাইরের লোক।
পুলিশের দলটি হোলি আর্টিজানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে আমিও। খানিক পর মনে হলো এত আগে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। একটু ধীরে ধীরে যাই। কিছুদিন আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে প্রথম আলোর কর্মীদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আমিও সে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ভাবলাম, প্রশিক্ষণের জ্ঞানটা কাজে লাগাই। পুলিশের প্রথম দলটা থেকে একটু পেছনে, এক পাশে চলে এলাম। এগোতে এগোতে ভাবলাম, ক্যামেরায় ছবি না তুলে মোবাইলে তুলি। ছবি তুলতে শুরু করলাম। এ সময় দু-একজন পুলিশ হোলি আর্টিজানের মূল গেটের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আর ঠিক তখনই জঙ্গিরা গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। হঠাৎ চারপাশ কাঁপিয়ে বিকট শব্দ হলো। সব পুলিশ দৌড়ে বের হতে শুরু করল। ঘটনাটা ঘটল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। বড়জোর দু-এক মিনিটে!
আমি দ্রুত রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোন দিক থেকে গুলি আসছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে রেস্তোরাঁ থেকে দুজন লোক ছুটে বের হয়ে এলেন। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে তাঁরা চিৎকার করছেন। চার-পাঁচ কদম এগিয়ে এসেই তাঁরা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন।
পরে শুনলাম, তাঁরা দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। একজন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম, আরেকজন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান। তাঁরা আমার খুব কাছেই পড়ে ছিলেন। একেবারে কাছে। চোখের সামনে তরতাজা দুজন মানুষ নিথর হয়ে গেলেন। এই ছিল, এই নেই! চারদিকে ধোঁয়া, গুলি, হট্টগোল, ছুটোছুটির মধ্যেই তাঁদের পুলিশ সহকর্মীরা দুজনের নিথর দেহ টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। ধোঁয়ার কারণে স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।
রাত ১০টার দিকে পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠল যে দৌড়ে পেছনের দিকে চলে গেলাম। সেখানে ট্রান্সকম গ্রুপের পরিচালক সিমিন হোসেন ও তাঁর বড় ছেলে যারেফ হোসেনকে পেলাম। জানতে পারলাম, সিমিন হোসেনের ছোট ছেলে ফারাজ আইয়াজ হোসেনও ওই রেস্তোরাঁয় আটকা পড়েছেন। সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া এই ছেলেটির মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠল চোখে। মাত্র কদিন আগেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমাদের অফিসে। কী বিনয়ী, মৃদুভাষী, সদা হাস্যময় এক তরুণ। মনটা উদ্বেগে ভরে গেল।
ছেলের খোঁজে সিমিন হোসেন তখন রীতিমতো দিশেহারা। বারবার তিনি পুলিশ আর সাংবাদিকদের কাছে ঘোরাফেরা করছিলেন। কে জানাবে তাঁকে, ফারাজ কেমন আছে? পারলে যেন উড়ে হোলি আর্টিজানের ভেতরে গিয়ে জিম্মিদশা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসেন ছেলেটিকে!
গভীর রাতে খবর এল, সেনা ও র্যাবের সদস্যরা হোলি আর্টিজানে অভিযান চালাবে। সে প্রস্তুতি চলছে। আমাদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হলো। আমরা হোলি আর্টিজানের পাশের একটা ভবনের নিচতলার গ্যারেজে ঢুকে গেলাম। তখনো আমরা জানি না, হোলি আর্টিজানের ভেতরে যাঁরা আছেন, তাঁদের কী অবস্থা? ফারাজ কেমন আছে?
প্রথমে এক দফা গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ হলো। এরপর আর কোনো শব্দ নেই। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। থমথমে আতঙ্কময় পরিবেশ। একেকটা মিনিট যেন একেকটা যুগ। ভোর চারটার দিকে আবার গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেল। চারপাশে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যেই বৃষ্টির মতো গুলির শব্দ। রেস্তোরাঁর ভেতরে থাকা জিম্মিদের ভালো-মন্দ তখনো আমাদের কিছুই জানা নেই। আর বাইরে তাঁদের স্বজনেরা নির্ঘুম চোখে মিটিমিটি আশা নিয়ে সময় গুনছেন।
ভোর হয়ে আসছে। দীর্ঘ রাতের কালো পর্দা সরিয়ে দিনের আলো ফুটছে। কিন্তু এই দিন আর সব দিনের মতো উজ্জ্বল নয়। এরই মধ্যে জানা গেল, ফারাজ আর নেই। তাঁর বন্ধুরাও কেউ বেঁচে নেই।
সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সাঁজোয়া যান নিয়ে দেয়াল গুঁড়িয়ে রেস্তোরাঁর আঙিনায় ঢুকে পড়ল সেনা কমান্ডোরা। ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর শুরু হলো ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে কেঁপে উঠল গোটা গুলশান। ১৩ মিনিটের মধ্যে সন্ত্রাসীদের কাবু করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল কমান্ডোরা। জীবিত উদ্ধার করা হলো ১৩ জিম্মিকে। ৫০ মিনিট পর অভিযানের সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো।
আমি ফারাজের বাবা-মা-ভাই, অবিন্তা কবীরের পরিবার, ভারতীয় মেয়ে তারিশি জৈনের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি, কীভাবে তাঁদের মুখের আলো করুণভাবে নিভে গেল। এমন অভিজ্ঞতা যেন আর কখনো কোনো মানুষের না হয়।
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
পাঠকের মন্তব্য