কাল ১ জুলাই হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির এক বছর পূর্ণ হবে। গত বছর এই দিনে জঙ্গিগোষ্ঠী হোলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে ২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। সেখানে জঙ্গিদের তাড়া করতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা। সেই দিবসটি সামনে রেখে আমরা স্মরণ করব দেশি-বিদেশি সেই মানুষগুলোকে, যাঁরা চরম নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন; আমরা সহমর্মিতা জানাব তাঁদের স্বজনদের, যাঁরা এক বছর ধরে শোক বয়ে বেড়াচ্ছেন এবং আগামী দিনগুলোতেও তাঁদের শোক বইতে হবে।
তারপরও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের এটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে, চেনা-অচেনা, জানা-অজানা অগণন মানুষ তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন ‘নিঃশেষে প্রাণ’ দেওয়া মানুষগুলোকে। এবং সেটি ঘটেছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম
থেকে পৃথিবীর অপর প্রান্তের শিক্ষালয় পর্যন্ত। একই সঙ্গে দেশে দেশে উচ্চারিত হয়েছে শান্তির বাণী। শান্তিকামী মানুষ ধিক্কার দিয়েছেন
জঙ্গি হন্তারকদের।
সেদিন যাঁরা হোলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন স্বজনদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে, তাঁরা এলেন লাশ হয়ে। কেন তাঁরা লাশ হলেন—এই প্রশ্নের জবাব নেই। এই মানুষগুলোর বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশি, যাঁরা এসেছিলেন বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে, যাঁরা এসেছিলেন ব্যবসা উপলক্ষে। আবার কারও–বা আসার উদ্দেশ্য ছিল বেড়ানো কিংবা স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। কিন্তু ঘাতকেরা প্রথম সুযোগেই বিদেশিদের নিশানা করল। সেদিন ফারাজ আইয়াজ হোসেন নামের যে তরুণকে জঙ্গিরা হত্যা করে, তিনি বাংলাদেশি জেনে তারা প্রথমে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ফারাজ আইয়াজ তাদের জানিয়ে দেন, তাঁর সঙ্গে আসা দুই বিদেশি বন্ধুকে রেখে তিনি কোনোভাবে যেতে পারেন না।
এরপর জঙ্গিরা ওই দুই বিদেশি বন্ধুসহ তাঁকেও হত্যা করে। বেঁচে থাকতে ফারাজ আইয়াজ ছিলেন মা–বাবার প্রিয় সন্তান, ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী। ছিলেন সহপাঠীদের প্রিয় বন্ধু। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে এনে দেয় মহত্ত্বের শিরোপা। বন্ধুর জন্য এমন ত্যাগ স্বীকার, মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করার সাহস সবার হয় না। চে গুয়েভারার মৃত্যুর পর কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ ফারাজের মৃত্যুর পর সুনীলের সেই কবিতার কথাই বারবার মনে পড়ে। কেবল ফারাজ নয়, সেদিন জঙ্গিদের হত্যাযজ্ঞের শিকার প্রত্যেকের মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়। তাঁদের সবার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। জীবন দিয়ে তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতা। ‘মানুষ মানুষের জন্য’।
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর একজন মার্কিন বিশ্লেষক বলেছিলেন, ৯/১১-এর আগের পৃথিবী আর পরের পৃথিবী এক থাকবে না। সত্যি এক নেই। তবে সেটি ভালো অর্থে নয়। মন্দ অর্থে পৃথিবী অনেক বদলেছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসে যত মানুষ মারা গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মারা গেছে সেই ঘটনাকেন্দ্রিক সংঘাত-হানাহানিতে। টুইন টাওয়ার হামলায় যে পরিমাণ সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ ধ্বংস হয়েছে গত দেড় দশকে ঘোষিত-অঘোষিত যুদ্ধে। ৯/১১-এর আগে জঙ্গিবাদ ছিল খুবই ছোট পরিসরে। তাদের তৎপরতা ছিল গুটিকয়েক দেশে। এখন তা বিস্তৃত হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে ও প্রান্তে। জঙ্গি দমনের নামে শক্তিধর দেশগুলো জঙ্গিবাদকে আরও উসকে দিয়েছে, যার ঝাপটা এসে পড়েছে আমাদের দেশেও।
কিন্তু আশার কথা হলো, হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশে যে পরিবর্তনটি এসেছে, সেটি সম্ভবত ভালো অর্থেই। হোলি আর্টিজানের পর শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে ব্যর্থ হামলার পর জঙ্গিরা অনেকটা খামোশ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তাদের সাঁড়াশি অভিযানে অনেক শীর্ষ জঙ্গি ধরা পড়েছে, অনেকে মারা পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সত্যিই জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে থাকে, সেটি দেশ ও জাতির জন্য স্বস্তির খবর। মুক্তিযুদ্ধ এবং লাখ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ-লালন-নজরুল-শামসুর রাহমানের বাংলাদেশও মৌলবাদের অভয় আশ্রম হতে পারে না।
আশির দশক থেকেই জঙ্গিরা এখানে উৎপাত চালিয়ে এলেও কখনোই সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়নি। জঙ্গিরা যতবারই হামলা করেছে, মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিশেষ করে হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর জনগণ যেভাবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণা জানিয়েছে, তা আমাদের আশা জাগায়। কিন্তু যখন দেখি সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে এই জঙ্গিদের ব্যবহার করছে গণতন্ত্রের নামাবলি পরা কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, তখন হতাশ হতে হয়। রাজনৈতিক পথ ও মতের ভিন্নতা থাকতে পারে, বিরোধ থাকতে পারে, তাই বলে মানবতা ও সভ্যতার শত্রু এই জঙ্গিদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিতে হবে? এটি কেমন রাজনীতি?
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, জঙ্গিবাদ কেবল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়; এটি রাজনৈতিক সমস্যা। একইভাবে বৈশ্বিক সমস্যাও। কোনো একক দেশ বা দলের পক্ষে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই সম্মিলিতভাবেই এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে মোকাবিলা করতে হবে। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে যুক্ত করতে হবে জঙ্গিবিরোধী লড়াইয়ে।
হোলি আর্টিজান দিবস প্রতিবছর আসবে। কিন্তু এ ধরনের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই ঘটতে দেওয়া যাবে না। হোলি আর্টিজানের শোককে আমরা শক্তিকে রূপান্তরিত করব। হোলি আর্টিজানের নৃশংসতা সবার মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত করুক, এটাই প্রত্যাশা। জঙ্গিদের নিশানা হয়ে জীবন দিতে হয়েছে অনেক লেখক শিক্ষাবিদ, বিচারক ও সংস্কৃতিসেবীকে। আবার জঙ্গিবাদের ভুল দর্শনে দীক্ষিত হয়ে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণও হারিয়ে গেছে। এই ক্ষতি আর কোনোভাবে বাড়তে দেওয়া যাবে না। বিদেশে আমাদের অনেক বদনাম হয়েছে। এখনই ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।
জঙ্গিবাদ হলো একটি মারাত্মক ব্যাধির নাম। ক্যানসারের মতো এই ব্যাধি সমাজ-দেহের কোষে কোষে প্রবেশ করে পুরো সমাজেরই প্রাণশক্তি রহিত করে দেয়। সমাজের যা কিছু ভালো, যা কিছু শুভ, যা কিছু কল্যাণকর, জঙ্গিবাদ তা নিঃশেষ করে দেয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া প্রভৃতি দেশ। এই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে, সামাজিকভাবে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং বহু গোত্র-বর্ণে বিভক্ত। সেদিক থেকে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। এখানকার অধিকাংশ মানুষ একই নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের চেহারা, বর্ণ, ভাষাও অভিন্ন। এ রকম একটি সমমাত্রিক সমাজে জঙ্গিবাদের উত্থান স্বাভাবিক নয়। তারা সাধারণ মানুষের সমর্থনও পায়নি। এ কারণেই আমরা দেখি, মা–বাবা জঙ্গি সন্তানের লাশ নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। জঙ্গি সন্তানকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আছে কি নেই, সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। একদল লোক প্রাণঘাতী বোমা-গ্রেনেড ছুড়ে, ধারালো অস্ত্রের মহড়া দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, জঙ্গি আছে। মাজারে-গির্জায়, জনসভায়-সাংস্কৃতিক সম্মেলনে, সিনেমা হলে-যাত্রা প্যান্ডেলে বোমা হামলা চালিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, জঙ্গি আছে। এক দিনে প্রায় একই সময়ে দেশের ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, জঙ্গি আছে। আত্মঘাতী বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ খুন করে তারা জানিয়ে দিয়েছে, জঙ্গি আছে। গত
বছর ১ জুলাই হোলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে ২২ জন নিরীহ মানুষ হত্যা করে জানিয়ে দিয়েছে, জঙ্গি আছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায়ও জঙ্গিরা তাদের শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
২০০৫ সালের জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশের ইসলামি জঙ্গিদের উত্থান নিয়ে একটি সরেজমিন রিপোর্ট করেছিল। যার শিরোনাম ছিল ‘দ্য নেক্সট ইসলামি রেভল্যুশন?’ রিপোর্টার এলিজা গ্রেসউন্ড লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার বা পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী প্রদেশ কিংবা এলাকাসমূহ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বিস্তারের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশগুলো নিজেদের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকেই এদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইসলামি গোষ্ঠীগুলো জিহাদের কেন্দ্র আফগানিস্তানে সংগঠিত হতে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে হরকাতুল জিহাদ। এর মূল নেতা ফজলুর রহমান। তিনি ১৯৯৮ সালে ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত জিহাদের ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। ওই ঘোষণা আল-কায়েদাকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করেছে। বাংলা ভাই এবং অন্য ইসলামি গোষ্ঠীগুলো এরপর থেকে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে এবং তারা ক্ষমতা দখলের জন্য সক্রিয় চেষ্টাও চালায়।’
সে সময়ের শীর্ষ জঙ্গিরা এখন আর নেই। ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। কয়েক মাস আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে হুজিবি নেতা মুফতি হান্নানের। কিন্তু জঙ্গিবাদী তৎপরতা থেমে নেই। উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো নতুন খবর হলো, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে কোনো কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটি গাড়া। আরএসওর উত্তরসূরি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হারাকা আল ইয়াকিন।
২০০১ সালের শুরুতে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ঘাঁটি গেড়ে থাকা আরএসও নেতা মোহাম্মদ সেলিমুল্লাহকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি আদালতে স্বীকার করেন, তাঁর অধীনে পাঁচ শতাধিক জিহাদি বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তাঁর কম্পিউটার থেকে গোয়েন্দারা যেসব ছবি উদ্ধার করেছে, তাতে দেখা যায়, ইসলামের সৈনিকেরা একে-৪৭ রাইফেল পাহারা দিচ্ছে কিংবা বিশ্রামে রয়েছে। এগুলো দাতাদের কাছে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেলিমুল্লাহ বলেন, অন্যান্যের মধ্যে সৌদি আরব ও লিবিয়ার সমর্থকদের কাছ থেকে তাঁরা অস্ত্র পেয়ে থাকেন।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আল-কায়েদাকে পেছনে ফেলে আইএস এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশেও জেএমবি বা বাংলা ভাইয়ের অনুসারীরা পিছিয়ে পড়লেও নতুন নামে নতুন গোষ্ঠী মাঠে নেমেছে।
তাই, জঙ্গিরা দুর্বল বলে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই।
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
পাঠকের মন্তব্য