উপকূলের খবরওয়ালা রফিকুল ইসলাম মন্টু

প্রান্তিকের পিছিয়ে থাকা মানুষ, জেলে, বিপন্ন কিংবা সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশে যান। সে কারণে উপকূলের বহু মানুষের কাছে তিনি ‘উপকূল বন্ধু’ নামে পরিচিত। এছাড়াও কাজের নিরিখে উপকূলের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও অনেক উপাধি পেয়েছেন তিনি। কেউ বলেন, ‘উপকূলের বাতিঘর’, কেউবা বলেন ‘উপকূলের দিশারী’, কোন কোন এলাকায় তিনি ‘রানার’ কিংবা ‘সংবাদ শিল্পী’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন।

তিনি উপকূল-সন্ধানী সংবাদকর্মী। উপকূলের খবর লিখেন নিয়মিত গণমাধ্যমে। সব সময় ভাবনায় ঘুরে উপকূলকে এগিয়ে নেওয়া জন্য কি করা যায়? জন্ম উপকূলীয় জেলা বরগুনায়। বেড়ে ওঠেছেন উপকূলের কাঁদা মাটিতে। উপকূলের যত আঁকা-বাঁকা পথ আছে সবই তার চেনা, সবই তার নখদর্পনে। উপকূলের দুঃসময়ে সাংবাদিকতা জগত যখন দৈনন্দিন খবরে ব্যস্ত, তখন এই মানুষটি উপকূলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেন। প্রান্তিকে প্রতিক্ষণ তার খবরের খোঁজ। এই মানুষটি আর কেউ নন, রফিকুল ইসলাম মন্টু। যার পরিচিতি উপকূলের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত। মেঘনার এপার থেকে ওপারে গেলে প্রান্তিকের মানুষ তাকে দেখে চমকে উঠে বলেন, ‘আরে! আপনাকে তো ওপার দেখে এলাম!’ কেউ হয়তো বলে ওঠেন, ‘একবার ঈদের দিন তো আপনি আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন!’

প্রান্তিকের পিছিয়ে থাকা মানুষ, জেলে, বিপন্ন কিংবা সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশে যান। সে কারণে উপকূলের বহু মানুষের কাছে তিনি ‘উপকূল বন্ধু’ নামে পরিচিত। এছাড়াও কাজের নিরিখে উপকূলের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও অনেক উপাধি পেয়েছেন তিনি। কেউ বলেন, ‘উপকূলের বাতিঘর’, কেউবা বলেন ‘উপকূলের দিশারী’, কোন কোন এলাকায় তিনি ‘রানার’ কিংবা ‘সংবাদ শিল্পী’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। সর্বপরি উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ-এর স্থানে উঠে এসেছে তার নাম। এরইমধ্যে তার কাজের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে। বেড়েছে উপকূলের মাঠ পর্যায়ের সংবাদ। বহু সংবাদকর্মী এখন রফিকুল ইসলাম মন্টুর পথে হাঁটছেন। উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে তৈরি করছেন সরেজমিন প্রতিবেদন।

সম্প্রতি সময়ে উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘুর্নিঝড় “মোরা”। আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে শুনেছেন ১০ ও ৮ নাম্বার মহা বিপদ সংকেতে উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো। ভোর বেলায় উপকূলে আঘাত হানতে পারে ঘুর্নিঝড়টি! কোথায় খাওয়া-দাওয়া? ঘুমহীন সারা রাত জেগে জেগে উপকূলের সব জায়গার খোঁজ নিয়েছেন। ভোরে ঘুর্নিঝড়টি আঘাত হানলো না। আবহাওয়া বার্তায় আবার বলা হলো ঘুর্নিঝড়টি ১১টা নাগাদ আঘাত হানতে পারে। কিছুক্ষণ ঘুম গিয়ে জেগে উঠলেন। যেন তিনি ঘুমের মধ্যে ঘুর্নিঝড়ে অসহায় মানুষের কাঁন্না শুনতে পেলেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন কক্সবাজারের টেকনাফ-মহেশখালী চট্টগ্রামের কতুবদিয়ায় অসংখ্য ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত! মোট ৭জনের মৃত্যুর সংবাদে তিনি নিজকে মানিয়ে নিতে পারলেন না। উপকূল সুরক্ষার ১২টি পরামর্শ তৈরি করেন। লিখেন প্রতিবেদন।

নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে নির্ভয়ে ছুটে যান। চরের অস্থায়ী উঁচু ঘরগুলোতে উঠে যান নির্বিঘ্নে। কখনো ঘুর্নিঝড়, কখনো তীব্র রোদ, কখনোও-বা পানিতে ভিজে সংবাদ সংগ্রহের পালা। জেলে, মানতা জনগোষ্ঠী, সিডর বিধ্বস্ত জনপদ, ছিন্নমূল শিশু, নদী ভাঙ্গায় তাড়িয়ে ফেরা মানুষ, লবণাক্ততার আঘাতে বিপন্ন প্রান্তিক, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট, অনগ্রসর জনপদ ও উপকূলের পড়ুয়াদের জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াইয়ের বাস্তব চিত্র উপলব্দি করে সবার দুঃসহ জীবন যেন তাকেও তাড়িয়ে ফেরে। বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে উপকূলে ব্যস্ত সময় পার করেন সংবাদ সংগ্রহে।

পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে পূর্ব দিকে টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ তথা ৭১০ কিলোমিটার তটরেখায় পদচারণা তার। প্রান্তিকের নানান সমস্যা আর সম্ভাবনার গল্প তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় গনমাধ্যমে। তথ্য-সংগ্রহ করে উপকূলের উন্নয়নে সহায়তা করতে চান। শুধু একটাই প্রচেষ্টা যেভাবেই হোক উপকূলকে এগিয়ে নেওয়ার। উচ্চ বেতনে শহুরে সাংবাদিকতার প্রস্তাব আসলেও উপকূলের স্বার্থে তিনি তা প্রত্যাহার করেন। তিনি জানেন, উপকূলের মানুষের কণ্ঠস্বর এখন আর মিড়িয়ায় চোখে পড়ে না। কেবল মাত্র ঘুর্নিঝড় এলেই গণমাধ্যম উপকূলের কথা স্মরণ করে। এজন্য তিনি চান সারাটি বছর উপকূলের সাথে থাকতে, উপকূলের প্রান্তিকের কণ্ঠস্বরকে খবরের শিরোনাম করতে।

উপকূলের সব ধরণের খবর লিখেন তিনি। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে বিশেষ নজর। এর স্বীকৃতিও মিলেছে। ঝুলিতে জমেছে অনেকগুলো অ্যাওয়ার্ড। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার, গ্রামীণফোন-ডিআরইউ অ্যাওয়ার্ড, ইউনিসেফ মীনা অ্যাওয়ার্ড, পিআইবি-এটুআই অ্যাওয়ার্ডসহ বেশকিছু জাতীয়-আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি।

উপকূলকে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে তার সামনে উঠে আসে উপকূলের পড়ুয়াদের মাঝে তথ্য শূন্যতার চিত্র। ভাবতে থাকেন ওদেরকে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়? মাথায় আসলো অল্প খরচে, অল্প সময়ে দেয়ালপত্রিকা ‘বেলাভূমি’তে ওদের লেখালেখির মাধ্যমে তথ্য সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা। ২০১৪ সাল থেকে এই ব্যতিক্রমীধারার দেয়াল পত্রিকা ‘বেলাভূমি’র যাত্রা শুরু হয়। এখন উপকূলের শতাধিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। যার মাধ্যমে বিরাট এক সম্ভবনা নতুন করে হাতছানি দিচ্ছে। যার চমৎকার লেখনির দিকে তাকালে খুব কাছ থেকেই উপকূল অঞ্চলটা বাস্তবে চোখের সামনে ভেসে আসে। উপকূল পড়ুয়াদের লেখালেখি, জ্ঞান ও সৃজনশীল মেধার বিকাশ আর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য সামনে রেখে তিনি উদ্যোগ নেন “আলোকযাত্রা দল” গঠণের । উপকূলজুড়ে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ উপকূলের ১৫ স্থানে গঠিত হয়েছে ‘আলোকযাত্রা দল”। এই দলের সদস্যরা নিজেরাই বার্ষিক কর্মপরিকল্পণা প্রণয়ন করছে, নিজেরাই কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।

ঘুনির্ঝড়ের বাতাস, লবণাক্ততার প্রভাব, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি-এই তিন নির্দেশকে আবর্তত উপকূলের ১৫টি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে তার সংবাদ সংগ্রহে ছুটে চলা, উপকূল নিয়ে গবেষণা। আর সেই ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো হচ্ছে, উপকূলের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী ও মধ্য উপকূলের জেলাগুলো হচ্ছে, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, চাঁদপুর এবং পশ্চিম উপকূলের বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা। আর এই জেলাগুলোতেই তথ্যের জন্য ছুটাছুটি তার। যা বিশ্বে এক ভিন্ন ধারার সাংবাদিকতার প্রবর্তনও বলা যায়। বিশ্বে অন্য কোথাও এমন ব্যতিক্রমীধারার সাংবাদিকতার নজির খুঁজে পাওয়া যায়নি। গোটা উপকূল অঞ্চল তার নখদর্পনে। উপকূল-সন্ধানী এই সাংবাদিককে দেখে অবাক উপকূলের মানুষ। এখন তাকে সবাই ‘‘উপকূল বন্ধু’’ নামেই ডাকে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ বেশ কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মানুষ। তার কার্যক্রম নজরে আসে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএননিউজের। ডাক পেয়েছিলেন ‘‘ইয়াং নাইট’’ অনুষ্ঠানে। দর্শক মতামতেও তিনি “উপকূল বন্ধু” শব্দটির খ্যাতি লাভ করেন। তার কার্যক্রম নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র।

যুগ যুগ ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা উপকূল অঞ্চলের অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে তিনি নিজে যেমন চেষ্টা করছেন, তেমনি স্থানীয় সাংবাদিক এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদেরকেও সহায়তা করছেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করছেন, স্থানীয় পত্রিকার সঙ্গে ইস্যুভিত্তিক সংখ্যা বের করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তিনি চান সবাইকে নিয়েই উপকূলকে এগিয়ে নিতে। তার নেতৃত্বে উপকূল জুড়ে তিন ধরণের কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। একটি হচ্ছে সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক, আরেকটি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের নেটওয়ার্ক, এবং আরেকটি তৃণমূল স্তুরের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতকরা ছাড়াও, উন্নয়নকে সহায়তা করছে।

উপকূলের ইস্যুসমূহে আরও গুরুত্বপূর্ন করে তুলতে ১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’ পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০১৬ সালে তিনিই প্রথমবারের মত উপকূল দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করে লেখালেখি শুরু করেছেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূলের ওপর দিয়ে যে ভয়াল ঘুর্নিঝড় বয়ে গিয়েছিল, তাতে প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উপকূল এরচেয়ে বড় ঘুর্নিঝড় আর কখনো দেখেনি। উপকূল-সন্ধানী এই সাংবাদিকের প্রস্তাব, এই দিনটিতেই হতে পারে ‘উপকূল দিবস’।

উপকূল বন্ধু রফিকুল ইসলাম মন্টুর উপকূলকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকুক। ভবিষ্যৎ জীবনে সুস্থতায় কাটুক। উপকূল নিয়ে তিনি যেন তার স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন, এই প্রত্যাশা উপকূলবাসীর।

সর্বশেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:১৩
জুনাইদ আল হাবিব
কমলনগর প্রতিনিধি

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন